স্বাধীনতার এতদিন পরও তেরোঘরে ওড়েনি কোনো জাতীও পতাকা। আজও গ্রামে নেই কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নেই পানীয় জলের বন্দোবস্ত।নেই স্কুল, নেই নিরাপত্তা, নেই স্বীকৃতি, নেই স্বাধীনতা, নেই ......। এ যেন নেই রাজ্য। উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁর ছিটমহল 'তেরোঘর' । পাখির কলরবের বদলে এখনে মানুষের ঘুম ভাঙে জওয়ানদের বুটের শব্দে।বনগাঁ থেকে মাত্র ৮ কিমি দূরে 'তেরোঘর'। স্রোতহারা একটি খালের পাশে ছোট্ট গ্রাম। জলপথই একমাত্র ভরসা এখানে। নিরাপত্তা বলতে একমাত্র ভগবান। গ্রামের তিন দিক বাংলাদেশ। নেই কোন কাঁটাতারের বেড়া।গ্রামের দুপাশে বাংলাদেশ সেনাদের ছউনি। গ্রামের পাশের গ্রাম কালিয়ানি গ্রামে রয়েছে ভারতীয় সেনাদের ছউনি। জওয়ানদের মর্জির উপর নির্ভর করেই চলতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের ।
পেট্রাপোল সীমান্তের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে একটি খাল। ইছামতি নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে বয়ে গিয়েছে বাংলাদেশের ভিতর। মিশেছে কপতাক্ষ নদের সাথে । বিভিন্ন জায়গাই নানা নামে পরিচিত খালটি। কথিত আছে এই খাল দিয়ে যাতায়াত করত বড় বড় বজরা । খালটির দ্বীপে দোঘর বা মেদের ট্যাঁক গ্রাম। গ্রামের ওপারে তেরোঘর গ্রাম। দু ঘর পরিবার প্রথম বসবাস শুরু করেছিল বলে গ্রামটির নাম তেরোঘর। বর্তমানে গ্রামে ৫/৬ টি পরিবার বসবাস করে । অপরদিকে ১৩ টি পরিবার প্রথম বসবাস শুরু করলেও যত সময় গড়িয়েছে ততই কমেছে তেরোঘর এর পরিবারের সংখ্যা। সেখানে এখন মাত্র ৬/৭ টি পরিবার বসবাস করে। গ্রামে পৌঁছায় না রাজনৈতিক তরজা। ওরা রাজনীতি বোঝে না। ওরা মৌলিক অধিকার চায়। তবে ,সম্প্রতি দেশের দুএকটি নির্বাচনের আগে নেতাদের যাতায়াত ওদের মনে কিছুটা ধারনা গড়ে তুলেছে। যদিও প্রতিশ্রুতি ছাড়া কিছুই জোটেনি। দেশের স্বাধীনতার ৩ দিন পর স্বাধীন হয়েছিল বনগাঁ । তেরোঘর এর বাসিন্দারা এরও এক মাস পর সেনাবাহিনীর সীমান্ত নির্ধারণ পিলার দেখে বুঝেছিল তারা ভারাতবাসী।গ্রামে সকলেই জেলে সম্প্রদায়ের। মাছ ধরে জিবিকা নির্বাহ করে ওরা। ছোট্ট খালটি বাঁচিয়ে রেখেছে ওদের। আবার বর্ষাকালে এই খালের জলেই দুকুল ভাসে ওদের।স্বাধীনতা শব্দটার সাথে ওদের যে কোন সম্পর্ক নেই তা ওদের কথাতেই বোঝা যায় । ওরা জানে দুর্গম পথ পেরিয়ে বাজারে মাছ বিক্রি করেই ওদের খেতে হবে। নিজ গৃহে বাস করেও ওরা যেন পরবাসী। নিজের দেশে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা যেতে ওদের অনুমতির প্রয়োজন হয়। অথচ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গাই ওরা সহজেই যেতে পারে । আজও বাড়ির মেয়েকে অন্যের বাড়ি রেখে বিয়ে দিতে হয়। বাড়িতে অতিথি এলে জওয়ানদের অনুমতি লাগে। এত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বাপ ঠাকুরদার রেখে যাওয়া ভিটে মাটি আঁকড়ে পরে আছে ওরা। একটাই আশা যদি কখনও জোটে স্বীকৃতি । স্বাধীন দেশের নাগরিক ওরা। স্বাধীনতার কথা শুনলেই অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে একে অপরের দিকে। ভারতবাসীর কাছে এর চেয়ে লজ্জা আর কি হতে পারে ?
বদলেছে যুগ, বদলেছে সমাজ। বদলেছে ওরাও। অতীতের তেরোঘরের সাথে পার্থক্য গড়েছে বর্তমান । অতীতে তেরোঘরের বাসিন্দারা সহজেই মিশতে পারত পূর্ববঙ্গের সাথে।ক্রমশ খারাপ পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের নাগারিকদের সাথে সম্পর্ক । সাবলীলভাবে প্রকাশ্যে আর ওদের সাথে মিশতে পারে না। কূটনৈতিক টানাপড়েনে জওয়ানদের চোখরাঙ্গানি ওদেরকে ভীত করে তুলেছে। আজ আর ঢেউ উঠেনা মরা খালে । বহু বাঁধা পেরিয়ে আজ স্কুলে যায় গ্রামের ছেলে-মেয়েরা। সেখানেই জানতে পারে স্বাধীনতার কথা। বাড়িতে পড়তে বসে দাদুর কাছে ছোট্ট মেয়েটি জানতে চাই , স্বাধীনতার মানে! ভুরু কুঁচকান আশি পেরানো বৃদ্ধ।
স্বাধীনতা দিবসে সারা দেশে ওড়ে জাতীয় পতাকা। সেদিনও তেরোঘরে ওড়ে না জাতীয় পতাকা। দূরে জাতীয় পতাকা দেখে ছুটে যান বৃদ্ধ। চোখে মুখে হাসি। বেশিক্ষন স্থায়ী হয় না হাসি। জওয়ানদের ইশারা তাঁকে ফিরিয়ে দেয় ছোট্ট টালির ঘরে।
---- কুন্তল পাল