Monday, September 14, 2020

স্বাধীনতার ৭২ বছর পার, তেরোঘরে আজও উড়ে না কোনো জাতীয় পতাকা

         




        স্বাধীনতার এতদিন পরও তেরোঘরে ওড়েনি কোনো জাতীও পতাকা। আজও গ্রামে নেই কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নেই পানীয় জলের বন্দোবস্ত।নেই স্কুল, নেই নিরাপত্তা, নেই স্বীকৃতি, নেই স্বাধীনতা, নেই ......। এ যেন নেই রাজ্য। উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁর ছিটমহল 'তেরোঘর' । পাখির কলরবের বদলে এখনে মানুষের ঘুম ভাঙে জওয়ানদের বুটের শব্দে।বনগাঁ থেকে মাত্র ৮ কিমি দূরে 'তেরোঘর'। স্রোতহারা একটি খালের পাশে ছোট্ট গ্রাম। জলপথই একমাত্র ভরসা এখানে। নিরাপত্তা বলতে একমাত্র ভগবান। গ্রামের তিন দিক বাংলাদেশ। নেই কোন কাঁটাতারের বেড়া।গ্রামের দুপাশে বাংলাদেশ সেনাদের ছউনি। গ্রামের পাশের গ্রাম কালিয়ানি গ্রামে রয়েছে ভারতীয় সেনাদের ছউনি। জওয়ানদের মর্জির উপর নির্ভর করেই চলতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের । 



পেট্রাপোল সীমান্তের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে একটি খাল। ইছামতি নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে বয়ে গিয়েছে বাংলাদেশের ভিতর। মিশেছে কপতাক্ষ নদের সাথে । বিভিন্ন জায়গাই নানা নামে পরিচিত খালটি। কথিত আছে এই খাল দিয়ে  যাতায়াত করত বড় বড় বজরা । খালটির দ্বীপে দোঘর বা মেদের ট্যাঁক গ্রাম। গ্রামের ওপারে তেরোঘর গ্রাম। দু ঘর পরিবার প্রথম বসবাস শুরু করেছিল বলে গ্রামটির নাম তেরোঘর। বর্তমানে গ্রামে ৫/৬ টি পরিবার বসবাস করে । অপরদিকে ১৩ টি পরিবার প্রথম বসবাস শুরু করলেও যত সময় গড়িয়েছে ততই কমেছে তেরোঘর এর পরিবারের সংখ্যা। সেখানে এখন মাত্র ৬/৭ টি পরিবার বসবাস করে। গ্রামে পৌঁছায় না রাজনৈতিক তরজা। ওরা রাজনীতি বোঝে না। ওরা মৌলিক অধিকার চায়। তবে ,সম্প্রতি দেশের দুএকটি নির্বাচনের  আগে নেতাদের যাতায়াত ওদের মনে কিছুটা ধারনা গড়ে তুলেছে। যদিও প্রতিশ্রুতি ছাড়া কিছুই জোটেনি। দেশের স্বাধীনতার ৩ দিন পর স্বাধীন হয়েছিল বনগাঁ । তেরোঘর এর বাসিন্দারা এরও এক মাস পর সেনাবাহিনীর সীমান্ত নির্ধারণ পিলার দেখে বুঝেছিল তারা ভারাতবাসী।গ্রামে সকলেই জেলে সম্প্রদায়ের। মাছ ধরে জিবিকা নির্বাহ করে ওরা। ছোট্ট খালটি বাঁচিয়ে রেখেছে ওদের। আবার বর্ষাকালে এই খালের জলেই দুকুল ভাসে ওদের।স্বাধীনতা শব্দটার সাথে ওদের যে কোন সম্পর্ক নেই তা ওদের কথাতেই বোঝা যায় । ওরা জানে দুর্গম পথ পেরিয়ে বাজারে মাছ বিক্রি করেই ওদের খেতে হবে। নিজ গৃহে বাস করেও ওরা যেন পরবাসী। নিজের দেশে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা যেতে ওদের অনুমতির প্রয়োজন হয়। অথচ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গাই ওরা সহজেই যেতে পারে । আজও বাড়ির মেয়েকে অন্যের বাড়ি রেখে বিয়ে দিতে হয়। বাড়িতে অতিথি এলে জওয়ানদের অনুমতি লাগে। এত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বাপ ঠাকুরদার রেখে যাওয়া ভিটে মাটি আঁকড়ে পরে আছে ওরা। একটাই আশা যদি কখনও জোটে স্বীকৃতি । স্বাধীন দেশের নাগরিক ওরা। স্বাধীনতার কথা শুনলেই অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে একে অপরের দিকে। ভারতবাসীর কাছে এর চেয়ে লজ্জা আর কি হতে পারে ?




বদলেছে যুগ, বদলেছে সমাজ। বদলেছে ওরাও। অতীতের তেরোঘরের সাথে পার্থক্য গড়েছে বর্তমান । অতীতে তেরোঘরের বাসিন্দারা সহজেই মিশতে পারত পূর্ববঙ্গের সাথে।ক্রমশ খারাপ পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের নাগারিকদের সাথে সম্পর্ক । সাবলীলভাবে প্রকাশ্যে আর ওদের সাথে মিশতে পারে না। কূটনৈতিক টানাপড়েনে জওয়ানদের চোখরাঙ্গানি ওদেরকে ভীত করে তুলেছে। আজ আর ঢেউ উঠেনা মরা খালে । বহু বাঁধা পেরিয়ে আজ স্কুলে যায় গ্রামের ছেলে-মেয়েরা। সেখানেই জানতে পারে স্বাধীনতার কথা। বাড়িতে পড়তে বসে দাদুর কাছে ছোট্ট মেয়েটি জানতে চাই , স্বাধীনতার মানে! ভুরু কুঁচকান আশি পেরানো বৃদ্ধ। 


স্বাধীনতা দিবসে সারা দেশে ওড়ে জাতীয় পতাকা। সেদিনও তেরোঘরে ওড়ে না জাতীয় পতাকা। দূরে জাতীয় পতাকা দেখে ছুটে যান বৃদ্ধ। চোখে মুখে হাসি। বেশিক্ষন স্থায়ী হয় না হাসি। জওয়ানদের ইশারা তাঁকে ফিরিয়ে দেয় ছোট্ট টালির ঘরে।


---- কুন্তল পাল   

লজেন্স ! হাসায়- কাঁদায়

        


উপরে শক্ত আবরণ যুক্ত রং বে রং এর ছোট্ট মিষ্টি সুস্বাদু  একপ্রকার খাবারই লজেন্স। বাচ্চা-বুড়ো সকলের কাছেই এর সমান গ্রহনযোগ্যতা। ছোট্ট এই খাবারটির স্বাদ নেন নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।  বাচ্চাদের বায়না ভোলানো থেকে বয়স্কদের অবসর সময় কাটানোয় লজেন্সের ভূমিকা অপরিসীম। আমাদের সমাজে ক্যাণ্ডি , ট্রফি নানা নামে পরিচিত লজেন্স। 

লজেন্স শক্ত এক প্রকার মিষ্টি। যা চুষে বা চিবিয়ে খেলে ভিতরে নরম। যেটা চিনি এবং মাখন একসাথে সেদ্ধ করে তৈরি হয়। বিভিন্ন রকম  স্বাদের জন্য এর সাথে অন্যান্য রং বা গন্ধজাত দ্রব্য মিশ্রণ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে কাজু বাদাম বা নারকেলও মিশ্রণ করা হয় আরও সুস্বাদের জন্য। লজেন্স সবচেয়ে জনপ্রিয় যাদের কাছে সেই শিশুদের কথা মাথায় রেখেই দিন দিন বদলাচ্ছে লজেন্সের স্বাদ-বর্ণ-গন্ধ। আরও আকর্ষনীয় করার জন্য বদলাচ্ছে আকারও। বাবা মায়ের কাছে বায়না ভোলানোর সহজ ও আদি উপায় এই লজেন্স। যা মূহুর্তের মধ্যে বাচ্চার কান্না থামিয়ে দেয়। মাছ লজেন্স, কাঠি লজেন্স, টিকটিকি লজেন্স একসময় বাচ্চাদের কাছে খুবই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। যদিও অতীত দিনের সেই সব লজেন্স আজ আর দেখা যায় না। এসবের জায়গায় এসেছে নামিদামী কোম্পানির ক্যাটবেরী। 


স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস, বড়দিন প্রভৃতি দিনে স্কুল বা ক্লাবের থেকে পাওয়া একটি লজেন্স আজও শিশু মনে আনন্দ দেয়। ট্রেনে বসে অবসর সময় কাটাতে লজেন্সের জুরি মেলা ভার। ঠাণ্ডা লেগে গলার অস্বস্থি কাটাতেও লজেন্স খুবই উপকারি। লজেন্স যেমন আনন্দ দেয় , খুশিতে রাখে, একাকিত্ব ভোলায় , আবার এই লজেন্সই মানুষকে কাঁদায়। সারা জীবনের জন্য চোখে জল এনে দেয় এই লজেন্স।এই লজেন্সই জীবনে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। খবরের কাগজ খুললেই চোখে পড়ে ‘ লজেন্সের লোভ দেখিয়ে জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রীকে যৌন হেনস্থা’। কিংবা ‘লজেন্সের লোভ দেখিয়ে নাবালিকাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষন করে খুন করল প্রতিবেশী যুবক’। লজেন্স সারা জীবন এই নির্যাতিতা মানুষ ও তাদের পরিবারকে কাঁদায়। লজেন্সের নাম শুনলেই আঁতকে ওঠেন নির্যাতিতার মা। ট্রেনে সহকর্মীর কাছ থেকে লজেন্স খেয়ে বেঁহুশ হয়ে অনেকের সর্বস্ব খোয়া গিয়েছে। লজেন্স তাদের জীবনেও অভিশাপ।


---- কুন্তল পাল 

Friday, September 11, 2020

শিল কাটাবে শিল... ,শিল কাটাবে শিল...


শিল কাটাবে শিল... ,শিল কাটাবে শিল...।একটা সময় গ্রাম বাংলা এমন কি শহরের পাড়ায় পাড়ায় এই হাঁক শোনা যেত । হাতে ছোট একটা ব্যাগ নিয়ে ঘুরে ঘুরে বাড়িতে বাড়িতে শিল নোড়া কাটিয়ে জিবিকা অর্জন করতেন অনেকেই। দিনের শেষে যা আয় হত তা দিয়ে ভালভাবেই চলে যেত সংসার ।গৃহস্থের রান্না ঘরে মশলা বাটতে বাটতে মসৃণ হয়ে যাওয়া শিল নোড়া ফিরে পেত তার নতুন চেহারা। মশলা পেশায় করতেও কষ্ট কম হত। কিন্তু শিল নোড়া কাটানোর লোক আজ আর দেখা মেলে না। গ্রামবাংলাতেও মেলানো ভার। শক্ত পাথরের বুকে যারা খোদাই করে ফুটিয়ে তুলত শিল্প গৃহস্থের রান্না ঘরে তাদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে ।মানুষ বেশি করে যন্ত্র নির্ভর হয়ে পরেছে। মিক্সি মেশিনের যথেচ্ছ ব্যবহার এর ফলে গৃহস্থের রান্না ঘর থেকে শিল নোড়া প্রায় বিদায় নিয়েছে।বিদায়ের পথে শিল নোড়া কাটানো পেশাও। 

শক্ত পাথরের বুকে খোদাই করে সহজেই ছবি এঁকে দিতেন যারা , কাজটা কিন্তু অতটা সহজ ছিল না। তবুও পেশার তাগিদে অবলীলায় কাজটি করে যেতেন। কখনও মাছ, কখনও ফুল-ফল , কখনও পাখির ছবি ফুটে উঠত পাথরের শিলনোড়ায় ।ছোট একটা শেনি আর হাতুড়ি ছিল এদের কাজের হাতিয়ার । দীর্ঘদিন মশলা পেষার ঝাঁজ ও পাথরের গুঁড়োর হাত থেকে চোখ ও মুখকে রক্ষা করার জন্য কাপড়ের টুকরো ও চশমা ব্যবহার করতেন এরা । বর্তমান প্রজন্ম অনেকেই এই পেশা সম্পর্কে জানে না । আগামী প্রজন্ম হইতো জানবেই না এই পেশা সম্পর্কে ।



-- কুন্তল পাল   

 

Tuesday, September 8, 2020

কাঁথার দিন ফুরিয়েছে

         


জসিমউদ্দিনের ‘নকসিকাঁথার মাঠে’র কথা সকলেরই জানা। সাজু -রুপাইয়ের প্রেমকাহিনি প্রতিটি বাঙালিরই মনে গাঁথা আছে আজও। কাঁথায় যতœ করে ফুটিয়ে তোলা তাদের দুজনের প্রেম কাহিনি ভুলতে পারেনি কেউ। তবে কাঁথা বোনা প্রায় সকলেই ভুলে গিয়েছে। পুরানো কাপড় দিয়ে তৈরি রঙিন কাঁথার কথা আর কেউ বলে না। মা-ঠাকুমারা পুরানো কাপড় দিয়ে তৈরি করতেন সুন্দর সুন্দর কাঁথা।একটি কাঁথা পেতে মাপ আনতে কমপক্ষে দু-জনের  প্রয়োজন হয়। পাশের বাড়ির জ্যাঠিমা বা কাকিমার সাহায্যে পেতে নেওয়া দিনটিকে মনে রেখে শুরু হত কাঁথা বোনা। শেষ দিন এলে হিসাব করতেন কতদিন লাগলো কাঁথা বুনতে। পুরানো শাড়ির পাড় থেকে সুতো তুলে তা দিয়েই সেলাই করে ফুটিয়ে তোলা হত কাঁথা। কাঁথায় উঠে আসতো গ্রাম্যচিত্র। থাকত নানা জীবজন্তুর ছবি। ছেলের বিয়েতে নতুন কাঁথা দেবার রীতি ছিল মায়েদের কাছে।

কাঁথা সেলাই করার জন্য প্রয়োজনীয় ছিল সুঁচ, সুতো । এছাড়াও লাগত অংস্থান। মোটা কাপড় কেটে সেলাই করে অংস্থান বানিয়ে নিতে হত। অংস্থান আঙুলে পরেই কাঁথা সেলাই করতেন মা-ঠাকুমারা। রান সেলাই, হেম সেলাই, কাঁথাস্টিচ প্রভৃতি ছিল সেলাইয়ের মধ্যে অন্যতম। মেশিনে তৈরি বালাপোশ আর আধুনিক কম্বলের দাপটে আজ আর কাঁথার প্রয়োজন বোধ করে না কেউ। কাঁথা বোনার মানুষ গুলিও আজ আর  নেই। বর্তমান প্রজন্ম জানেই না কাঁথা বোনার পদ্ধতি। যে কারনেই আজ কাঁথা দেখা যায় না।


উল ও কাঁটার সাহায্যে সোয়েটার বা শীতের পোশাক বোনাও ছিল শিল্পের সমান। ক্রুশের সাহায্যে নানা ডিজাইনের পোশাক তৈরি হত একসময়। নামি দামি মেশিনের দাপটে সেসবের দিন ফুরিয়েছে। কেউ আর হাতে বোনা শীতের পোশাক পরতে চাই না। হারিয়েছে সে সব দিন। তবুও কোন কোন স্কুলে কর্মশিক্ষা ক্লাসের সৌজন্যে একটু বেঁচে আছে উল বোনা। তবে মায়েদের কালঘাম ছুটে যায় মেয়েদেরকে এসব শেখাতে। কারন মায়েরা তো অনেক আগেই এসবকে বিদায় জানিয়েছেন।

--- কুন্তল পাল

Sunday, September 6, 2020

আসন আর কেউ বোনে না

 


    টিন বা টালির চালের মাটির বাড়ি। গোবরে লেপা মসৃন বারান্দা। কোন অতিথি এলেই চালের আঁড়া থেকে একটি আসন এনে বসতে দেওয়া হত। মাটির কুঁজো থেকে একগ্লাস ঠাণ্ডা জল সঙ্গে তালপাতার পাখার ঠাণ্ডা বাতাস। এই ছিল মধ্যবিত্ত বাঙালির প্রথম আপ্যায়ন। বর্তমান সময়ে সেই আপ্যায়ন আর নেই। এসেছে দামি সোফা, ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানীয়। বাড়ির মা বোনেদের তৈরি সুন্দর সুন্দর আসন আজ আর দেখা যায় না। মাপ দিয়ে কাটা চটের বস্তার উপর উল ও সুতো দিয়ে বিভিন্ন চিত্র এঁকে ফুটিয়ে তোলার দিন শেষ হয়েছে। কখনও কখনও ছিট কাপড় কেটে ত্রিভ‚জের আকারে সেলাই করে বসিয়ে দেওয়া হত চটের উপর। পুরানো কাপড় দিয়ে পিছনের ও চারপাশের অংশ মুড়ে দিয়ে সুদৃশ্য করা হত। তালপাতা বা খেঁজুর পাতা দিয়েও বসবার আসন তৈরি হত। শীতের মরশুমে খেজুর গাছ ঝোড়ার সময় বাদ দেওয়া খেজুর পাতা সংগ্রহ করে কাখতেন বাড়ির মা বোনেরা। অবসর সময়ে সেই পাতা দিয়ে বুনতের আসন। এই সব আসন শিল্পের নিদর্শন হয়ে থাকত। 


বিকালবেলা শুকনো খেঁজুর পাতা নিয়ে পাড়ায় ঘুরে ঘুরে আসন বা চাটাই বোনার আনন্দই ছিল আলাদা। পাশের বাড়ির কাকিমা কিংবা বান্ধবীর সাথে চলত আসন বোনার প্রতিযোগিতা। চটের উপর কখনও কখনও নীতি কথাও ফুটে উঠত, যা বাড়ির দেওয়ালে যতœ সহকারে ঝুলিয়ে রাখা হত। সাদা কাপড়ের উপর বাচ্চাদের জন্য ছড়া বা ¯^রবর্ণ অথবা ব্যঞ্জনবর্ণ আজও গ্রামে গেলে কারও কারও বাড়িতে দেখা যায়। কার্পেট বা বাহারি সোফার ব্যবহারে সেসব আজ অতীত হয়েছে। আজ আর কেউ আসন ব্যবহার করে না। তবুও সুদৃশ্য চেয়ারে বসে আজও কারও কারও মনে পড়ে যায় আসনের কথা। দেওয়ালে ঝোলানো সুতোয় ফুটিয়ে তোলা নীতি কথাটি ধূসর মনে হয়--- ‘‘ ডালিম পাকিলে পড়ে নিজে ফেটে যায় / ছোটলোক বড় হলে বন্ধুকে কাঁদায়”


--- কুন্তল পাল



Friday, September 4, 2020

হারিয়ে গিয়েছে তালপাতার পাখা

     


এক'টা সময় ছিল মানব জীবন কিছু জিনিস ছাড়া চলত না ৷ যুগের পরিবর্তনের সাথে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক কিছুই । আধুনিক যন্ত্রচালিত মানব জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে বিদায় নিয়েছে তালপাতার পাখা । সেলুলয়েডের যুগে প্লাস্টিকের দাপটে তালপাতা আজ ব্রাত্য | কোলকাতার মত মহানগর নয় ! মফ্সলের শহর ঘুরেও আজ আর তালপাতার পাখা মেলানো যায় না । গাঁ গজ্ঞে হয় তো বা দুএকটা আজও স্বাক্ষ্য বহন করে চলেছে ৷

          ছোট ছোট নানা মাপের গোল গোল করে কাটা তালপাতার মাথা গুলি কঞ্চির চোছ দিয়ে মুড়ে দেওয়া হত ৷ যার ফলে সহজেই বাতাস কাটতে পারে । বাঁশের ফালি চিরে হাতাল লাগানো থাকে ৷ এখনও মুদির দোকানে ঝাটার সাথে বিক্রি হতে দেখা যায় । তবে তা যে কোন সময় হারিয়ে যাবার আশঙ্কায় দিন গুনছেন সাধারণ মানুষ । যদিও এ পাখার সাথে আসল তালপাতার পাখার পার্থক্য অনেক ৷ তালপাতার যে পাখা আমাদের চোখে ভাসে তার ধাঁচই আলাদা ৷ তালগাছের পাতার উপর নির্ভর করে পাখার আকার ৷ একটি পাতা দিয়ে সর্বোচ্চ দুটি পাখা তৈরি হয় ৷ পাতার ডাটি সমেত মাঝখান দিয়ে চিরে নেওয়া হয় ৷ সুবিধা মত ডাটি সাইজ করে তৈরি হয় হাতল । হাতল মসৃণ করে তেল মাখানো হয় ধরবার সুবিধার্থে ৷ পাতার শিরার মাপ করে গোল করে কাটা হয় , যাতে হাতলের সাথে যুক্ত থাকে সেদিকেও নজর রাখা হয় ৷পাতার ধার বরাবর বাঁশের সরু চোছ কাঠির মত আকারে সুতো দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয় , যাতে লখলখে না থাকে ৷ সহজেই যাতে নখের আঁচড়ে চিরে না যায় সেদিকেও নজর রাখা হয় | তবে , সবার আগে গাছ থেকে কাটার পর পাতাটিকে জলে ভিজিয়ে রাখা হয় ৷ না হলে শুকিয়ে ছোট হয়ে যাবার ভয় থাকে ৷ পাখাকে আরও সুন্দর করে তোলার জন্য তালপাতা চিরে সরু করে বরফি আকারে ধার বরাবর বেঁধে দেওয়া হয় ৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে আলতা দিয়ে সেই বরফি গুলি রং করে দেওয়া হত | মা -ঠাকুমারা রঙিন কাপড় বা কাপড়ের পাড় কুচি দিয়ে সেলাই করে পাখার ধার বরাবর বসিয়ে দিতেন ৷ হাতলে রঙিন সুতো জড়িয়ে দিতন যাতে প্রতিদিন ব্যবহারের ফলে তেল চিটে না হয়ে যায় ৷ অপরূপ এই পাখার শীতল বাতাসে জুড়িয়ে যেত প্রাণ ৷ শরীরের সব ক্লান্তি মুছে দিত পাখার হাওয়া ৷


          গ্রীষ্মের সময় বাড়িতে কেউ এলে বাড়ির ছোট দেরও দেখতাম তাঁর হাতে একটি পাখা এগিয়ে দিতে ৷ সাথে এক গ্লাস ঠান্ডা জল । ঠাকুমার পাশে শুয়ে অচিনপুরের গল্প শোনার অভিজ্ঞতা প্রায় সকলেরই আছে | গল্প বলতে বলতে ঠাকুমা হাতপাখা নেড়ে হাওয়া করতেন, কখন যেন ঘুমিয়ে পড়তাম ৷ ঘুমের ঘোরে পাখা নাড়ার শব্দ অপরূপ লাগত ৷ ঠাকুমাও ঘুমিয়ে পড়তেন ৷ ঘুমের ঘোরে গায়ে পাখার আঘাত লাগলে অদ্ভুত এক নিয়ম মেনে ক্ষমা চেয়ে নিতেন , পাখাটা মাটিতে ঠুকে নিতেন ৷ এ যেন মাটিতে মাথা ঠোকা ৷ শুধু শোবার ঘরে নয় , উনুনে বাতাস দেবার জন্য উনুনের পাশেও থাকত কালি ঝুলি মাখা একটা পাখা ৷ উনুনে হাওয়া দেওয়ার সময় পাখার শব্দ অদ্ভুত লাগত I জামাইষষ্ঠীর দিনে তালপাখা জলে ভিজিয়ে জামাইদের শুভ কামনায় শাশুড়ি বলতেন , ' ষাট্ ষাট্ , ষষ্ঠীর ষাট্ ' ৷ এ ছবি আজও দেখা যায় , তবে তা সিনেমায় ৷ 

          পাখা শুধু বাতাস দেওয়ার জন্যই নয় , মাছ চুরি করে পালানোর সময় বিড়াল কেই পাখার বাড়ি হজম করতে হত । মায়ের ঘুমের সুযোগে আচঁলের পয়সা 'চুরি' করে পাখার বাড়ি খেতে হয়েছে অনেক কেই ৷ তবে এসবের মধ্যে আনন্দও ছিল ৷ যা আজকের ছেলে-মেয়েদের কাছে গল্প কথা । এসব থেকে তারা বঞ্চিত হলেও আধুনিক এসি মেশিন তাদের সেই ব্যথা অনেকটাই মুছে দিয়েছে ৷ ইলেকট্রিক ফ্যান ও এসির বাতাসে মুছে গিয়েছে তালপাতার পাখার নাম ৷


      ....কুন্তল পাল 

Sunday, July 5, 2020

হারানোর পথে কুমোড়রা

   
"কুমোড় পাড়ার গরুর গাড়ি / বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি " - কবিতায় কুমোড়পাড়া থাকলেও বাস্তবে আজ আর কুমোড়পাড়া দেখা যায় না বললেই চলে ৷ যদিও বা কোথাও কোথাও দেখা যায় তার সাথে অতীত দিনের কুমোড়পাড়ার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না | কালের পরবর্তনের সাথে সাথে কুমোড় পাড়া আজ শুধুমাত্র ঠিকানায় এসে দাড়িয়েছে ৷ যে পাড়ায় একসময় মাটির পাত্র পোড়ানোর গন্ধে বাতাস ভরে যেত , সেখানকার বাতাসে আজ আর পোড়া মাটির গন্ধ পাওয়া যায় না । মাটির পাত্র পোড়াবার ঘরগুলি আজ স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । কোথাও কোথাও সেই চিহ্নটুকুও নেই ৷ অজপাড়া গাঁ ঘুরে যদিও বা দু-একটি কুমোড় কে দেখা মেলে , তারা আজ যন্ত্র নির্ভর । তাদের তৈরি মাটির পাত্রে নেই কোন শিল্পের ছোঁয়া ৷ তাদের লক্ষ্য একটাই পেশাটাকে বাঁচিয়ে রাখা ।
          কুমোড়দের কাজের প্রধান জিনিস চাক বা চাকা । চাক ঘুরিয়েই তার সাহায্যে তৈরি হত মাটির জিনিস । পোন ঘরে বসে ডুকনি বা কেঠে , বউল্লা ও পিট নির সাহায্যে মাটির পাত্রের পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া হত । শেষে পোনে পুড়িয়ে বাজারে নিয়ে যাওয়া হত বিক্রির জন্য | চাক দেখতে অনেকটা গরুর গাড়ির চাকার মত। চাকার নীচে থাকে 'আল' , যা তেঁতুল কাঠ দিয়ে তৈরি হয় ৷আলটি বসানো থাকে পাথরের উপর যাকে বলা হ্য় 'শিল '| চাকার মাঝখানে ছ্যানা মাটির চাঁই বসিয়ে দেওয়া হয় ৷ অনেকটা পিরামিডের মতন করে ৷ চাকার যে কোন একপ্রান্তে ছোট একটি গর্তে লাঠি বাঁধিয়ে চাক ঘোরানো হয় ৷ ঘুরন্ত চাকের মাটিতে হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হয় সুদৃশ্য মাটির পাত্র | পাত্র তৈরি হয়ে গেলে সরু বাঁশের চোঁছ দিয়ে কেটে আলাদা করা হয় এবং দু হাতের ফাঁকে অতি সতর্কতার সাথে ধরে আলাদা করা হয় শুকানোর জন্য ৷ অর্ধ শুকনো মাটির পাত্রের সাথে গোলাকার মাটির চাকতি জুড়ে দেওয়া হয় । ডুকনির মধ্যে রেখে 'বউল্লা ' দিয়ে পিটিয়ে বড় করা হয় মাটির চাকতি ৷ এরপর পিটনি দিয়ে আস্তে আস্তে বাড়ি মেরে জোড়া লাগানো হয় ৷ শক্ত ও মোটা দেশলাই বাক্সের মতন কাঠের মাঝখানে গোল করে কেটে অনেকটা মালসার মত আকার দেওয়া হয় , যাকে ডুকনি বলে । ডুক নির মধ্যে গোলাকার মাটির চাকতিকে বউল্লা দিয়ে পিটিয়ে বড় করা হয় । বউল্লা দেখতে উল্টানো ঘটের মত । পোড়া মাটি বা পাথরের তৈরি । পাত্রের দুটি অংশ জোড়া লাগানোর পর পিটনি দিয়ে পিটিয়ে পাত্র তৈরি হয় ৷ পিটনি দেখতে ছোট ক্রিকেট ব্যাটের মত ৷ কাঠের তৈরি ৷ পূর্ণাঙ্গ পাত্র রোদে শুকিয়ে তারপর পোনে পোড়ানো হয় ৷
          পুড়িয়ে পাকা করাও কম ঝামেলার নয় ৷ যেখানে মাটির পাত্র পোড়ানো হয় তাকে 'পোন ' বলে ৷ বেশ কিছুটা উঁচু করে জায়গা জুড়ে মাটির দেওয়াল দেওয়া থাকে ৷ মাঝখানেও ছোট করে একই ভাবে মাটির দেওয়াল দেওয়া থাকে ৷ তাতে মাটি দিয়ে ছাদও দেওয়া হয় | ছোট গোলাকার এই অংশ টিকে 'তালকা' বলে ৷ তালকার চারিপাশে নীচের দিকে ছোট ছোট ছিদ্র থাকে , যেখান দিয়ে আগুন বের হয় ৷  তালকার নীচ দিয়ে সুরঙ্গ করে বাইরে মুখ বার করা হয় , যেখান দিয়ে আগুন ধরানো হয় ৷ আগুন দেবার এই মুখকে বলে 'মোয়ার' । শুকনো ঝরা পাতা দিয়ে আগুন করা হয় । এর ফলে আগুন ভালো হয় ৷ পোনের দেওয়ালের চারি দিকে নীচে ছোট ছোট ছিদ্র থাকে বাতাস আসা-যাওয়ার জন্য ৷ এই ছিদ্র গুলি কে 'ঝিল` বা 'গালা' বলে | মাটির পাত্র পোড়ানোর আগে পালা দেওয়া হয় | মাটির পাত্র সাজিয়ে কাঁচা ডালপালা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় একে 'পালা' বলে ৷ পালা দেবার পর তার উপরে পোড়া মাটির ভাঙা টুকরো বা খাবরা দেওয়া হয় ৷ এরপর কাদামাটির প্রলেপ ৷ সবশেষে মোয়ারের মুখে আগুন ধরানো হয় ৷ ঝিল বা গালার মুখ দিয়ে দেখে বোঝা যায় পোড়ানো হয়েছে কিনা ৷ পোড়ানো শেষ হয়ে গেলে বেশ কয়েক ঘন্টা পর ঠান্ডা হলে সাবধানে বের করা হয় পোড়া মাটির পাত্র ৷ এভাবেই তৈরি হয় কলসি , হাঁড়ি , রসের ভাঁড় প্রভৃতি ৷ এই পোড়া মাটির পাত্র গরুর গাড়ি করে বংশিবদন ও ভাগ্নে মদন হাটে নিয়ে যেতেন , যা আজ আর দেখা যায় না ৷

     ___ কুন্তল পাল

Monday, June 22, 2020

হারিয়ে যাচ্ছে কামারশালা

     
         কর্মকার | চলতি ভাষায় কামার৷ এদের কর্মস্থলই কামারশালা ৷ শক্ত লোহা পিটিয়ে দা , কোদাল , কুড়ুল প্রভৃতি তৈরি হয় কামারশালায় । অতীত দিনের সেই কামারশালা আজ আর দেখা যায় না বললেই চলে ৷ দু-একটি আজও অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছে । নতুন করে এই পেশায় আজ আর কেউ আসতে চান না |
          অতীতের কামারশালা বলতে দু চালা বা একচালা ভাঙাচোরা একটি ঘর , দুচারটে যন্ত্রপাতি , একটু কয়লা ও আগুন । চারপাশে ভেসে বেড়াত কয়লা পোড়ার গন্ধ ৷ কানে আসত অদ্ভুত এক শব্দ , যা কামারদের প্রধান যন্ত্র 'হাপর ' থেকে আসত ৷ এছাড়াও থাকত 'নিন', হাতুরি  , চিমটা বা শাঁড়াশি, হাম্বুর প্রভৃতি | একপাশে ছোট্ট একটা চারিতে থাকত জল ৷ এই নিয়েই কামারদের সংসার ৷
           প্রধান যন্ত্র হাপর দেখতে অনেকটা লম্বালম্বি ভাবে চেরা প্যারাস্যুট বা চ্যাপটা বেলুনের মত ৷ ওই একই আকারের তিনটি কাঠের পাটাতনের প্রতিটির সাথে প্রতিটি চামড়া দিয়ে যুক্ত ৷ মাঝখানে ও শেষের কাঠে একটি করে চার কোণা দরজা থাকে ৷ শেষ প্রান্তে একটি সরু লোহার নল বের হয়ে উনুনের সঙ্গে যুক্ত থাকে ৷ নলটি একটি কাঠের মাধ্যমে উনুনে যুক্ত হয় , যার মাঝ বরাবর মোটা ছিদ্র থাকে I সেই ছিদ্র দিয়ে উনুনে বাতাস যায় ৷ হাপারের সাথে তিন বেড়ের শিকল লাগানো থাকে ৷ দুপাশে দুটি বাঁশের খুঁটি ও একটি আঁড়া , আঁড়ার সাথে লম্বালম্বি ভাবে একটি বাঁশের লাঠি | পিছনের দিকটি হাপরের সাথে শিকল দ্বারা যুক্ত ৷ লাঠির সামনের দিকে যুক্ত শিকল টেনে হাওয়া করা হয় । যত বেশি টানা হবে তত বেশি হাওয়া হবে | দু পাশে দুটি বাঁশের খুঁটি ও একটি আঁড়া, এটাই তিন বেড়ে ৷ হাপর তৈরিতে মূলত গরুর চামড়া ব্যবহার করা হয় । নিন অনেকটা ইংরাজি 'টি' অক্ষরের মত দেখতে শক্ত লোহার টুকরো , যেটা মাটির মধ্যে পোঁতা থাকে । এর উপর গরম লোহা রেখে পেটানো হয় । রেলের পাটি কেটে তৈরি করা হয় পাটা , পাটার উপর গরম লোহা রেখে কাটা হয় । কামারশালার একপাশে মাটির মধ্যে অর্ধেক পোঁতা অবস্থায় রাখা থাকে একটি মাটির পাত্র , যার মধ্যে জল থাকে ৷ লোহা পিটিয়ে জিনিস তৈরি হয়ে গেলে গরম জিনিসটিকে জলে ডুবিয়ে রাখা হয় I একে চারি বলে । দা , কোদাল , কুড়ুল  প্রভৃতি জিনিস তৈরিতে আলাদা আলাদা যন্ত্রের প্রয়োজন | সবকিছুই তৈরির পর উঁকো দিয়ে ঘষে ধারালো করা হয় ৷ একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ কামার উনুনের কয়লার রং ও লোহা পোড়ার গন্ধে বলে দিতে পারেন লোহা পোড়া হয়েছে কিনা ।
           একসময় চাষীদের কাছে কামারশালা খুবই প্রয়োজনীয় ছিল । নাঙলের ফাল পোড়াবার জন্য কামারশালায় ভিড় লেগেই থাকত I বর্তমানে মানব চালিত গরুটানা নাঙলের ব্যবহার কমেছে ৷ চাষীদের কাছেও কদর কমেছে কামারদের | নতুন লাট্টু কিনে আল পরানোর কামারদের কাছে ছুটে যেত যুবকরা । বর্তমানে লাট্টু খেলা দেখা যায় না বললেই চলে | ফলে যত দিন এগোচ্ছে তত কদর কমছে কামারদের । এক দিন হয়ত হারিয়ে যাবে এই পেশা ! হারিয়ে যাবেন কামাররা !

    .......কুন্তল পাল 

Wednesday, June 17, 2020

নেশায় মাতছে যুবসমাজ , ডেনড্রাইটে আটকে শৈশব

         কিছুদিন ধরে বাবা লক্ষ্য করছেন ছেলে দেরিতে ঘুম থেকে উঠছে ৷ রাতে বাড়িও ফিরছে দেরি করে। খিট খিটে স্বভাব , অল্পেতে রেগে যাওয়া এসব দেখে বাবার সন্দেহ হয়। হঠাৎ ছেলের কি হল ? এক দিন ছেলের টেবিলের ড্রয়ার খুলে বাবা অবাক ! এত ওষুধের খাপ ? কিসের ওষুধ এগুলি ? দোকানে দেখাতে দোকানদার যা বললেন তা শুনে বাক্ রুদ্ধ বাবা । জানতে পারলেন এগুলি ব্যথা ও ঘুমের ওষুধ । এইসব ওষুধ খেয়ে দিনের পর দিন নেশায় মাতছে ছেলে । বর্তমান সময়ে এভাবেই অনেক যুবক যুবতী নেশায় বিভোর হচ্ছে ৷ নানারকম ট্যাবলয়েড , কাশির সিরাপ তাদের এখন নেশার সঙ্গী ৷ সবকিছুকে ছেড়ে ওরা এইসব ওষুধ কেই বেছে নিয়েছে ৷ যা তাদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে । ব্যথার ওষুধ , ঘুমের ওষুধ , কাশির সিরাপ সহজেই মিলছে । কোন ডাক্তারি প্রেসক্রিপশন ছাড়ায় এক শ্রেণীর আসাধু ব্যবসায়ীরা দেদার বিকোচ্ছে এই সব ওষুধ ৷ পঙ্গু করে তুলছে যুব সমাজকে ৷
          নিজেদের সুবিধার্থে নেশাখোর যুবক যুবতীরা নামকরণ করেছে ওষুধের | দোকানে গিয়ে নিজেদের দেওয়া নাম বললেই মিলছে 'নেশার' ওষুধ ৷ 'পটল', 'নীল আকাশ' , 'ডাল' , 'সলটু' , 'রড ' প্রভৃতি নামে নেশাখোরদের কাছে পরিচিত এইসব ওষুধ ৷ নেশায় মেতে সহজেই অসামাজিক কাজে লিপ্ত হচ্ছে এরা |
          সমাজে ব্যাঙের ছাতার মত একের পর এক পানশালা গজিয়ে উঠেছে । সেসব পানশালায় গভীর রাত পর্যন্ত মদ্যপান করে চলেছে যুবক-যুবতীরা । ছাত্র-ছাত্রীরাও ভিড় করছে এসব পানশালায় । বয়সের কোন নিয়ম মানছে না পানশালা কর্তৃপক্ষ । পানশালাগুলির ভিতরে নানা অসামাজিক কাজ চলছে । স্কুলছুট কিশোররাও নেশায় আসক্ত হচ্ছে । মূলত পেটের টানে যারা এক দিন পড়াশুনাকে বিদায় জানিয়েছিল তারা আজ নেশায় আসক্ত | সকাল হলেই এরা বেড়িয়ে পড়ে রুটি রুজির খোঁজে । পিঠে ছেঁড়া বস্তা নিয়ে কেউ যায় কাগজ কুড়োতে কেউ বা ইঁটভাটা বা কোন দোকানে । কাজের ফাঁকেই নেশাক্ত হচেছ ওরা । ডেনড্রাইট বা মাথা ব্যথার মলম ওদের নেশার বস্তু | ডেনড্রাইটের আঠালো নেশায় আটকে যাচ্ছে ওদের শৈশব ৷ হেরোইন তো আছেই । এক টুকরো পলিথিনে আঠা নিয়ে শুরু হয় পথচলা ৷ জামার ভিতর রেখে দেওয়া পলিথিন থেকে মাঝে মধ্যে গন্ধ নিলেই নেশায় মেতে ওঠে ওরা । নেশায় বিভোর হয়ে নানা অসামাজিক কাজে লিপ্ত হচ্ছে ছোট ছোট ছেলেরা | অল্প দিনের মধ্যেই অন্ধকার জগতে প্রবেশ করছে ৷ কি কারনে ওরা বেছে নিচ্ছে এই জগত ? দারিদ্র্য , চুরি যাওয়া শৈশব , কুসংঘ , সামাজিক বঞ্চনা ও নেশার মোহ ওদেরকে অন্ধকার জগতে নিয়ে যাচ্ছে ৷ পরবর্তীতে এরাই হয়ে উঠছে নামকরা সুপারি কিলার । ঘুম কাড়ছে প্রশাসনের ৷ এক দিন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেলের সেল হচেছ ওদের ঠিকানা |

          ...কুন্তল পাল 

গ্রহের দোষ কাটান, বিফলে মূল্য ফেরত

           ব্যাবসায় মন্দা ? শরীর ভালো যাচ্ছে না ? চাকরিতে বাধা ? ছেলে-মেয়ের পড়াশুনায় মন বসছে না ? প্রেমে ব্যর্থ ? এসবই আপনার গ্রহের দোষ ! গ্রহের দোষ কাটান ৷ ভাবছেন কোথায় যাবেন ? আপনার এলাকাতেই আছেন , ভোলেবাবা , জয়বাবা , গৃহশ্রী , লক্ষ্মীশ্রী , শ্রীগুরু , দেবীদর্শন আরও কত শ্রী ৷ একই ছাদের নীচে সব সমস্যার সমাধান । বাত-অর্শ - ভগন্দর বিনা অপারেশনে মুক্তি ! মহিলাদের গোপন জটিল রোগ ? অনিয়মিত ঋতু ? সাদা স্রাব ? স্বপ্নদোষ ? নিমেষে সমাধান । লোকাল ট্রেনের কামড়ায় বড় বড় করে লেখা সঙ্গে ঠিকানা ও ফোন নাম্বার ৷ সঙ্গে মোটা মাইনের চাকরির প্রলোভন | ঠকবেন না , কোন ডিপোজিট নেই ৷ সব সমস্যার সমাধানের হাতছাবি ... বিফলে মূল্য ফেরত ।
          এটা কোন জ্যোতিষ কার্যালয় বা কোন চিকিৎসা কেন্দ্রের বিজ্ঞাপন নয় । যে কোন লোকাল ট্রেনে উঠলেই এমন চমকপ্রদ পোস্টার চোখে পড়বে ৷ এই প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্বান্ত হচেছন সাধারণ মানুষ ৷মোটা টাকা লুঠছে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীরা ৷ বিজ্ঞাপনের উপর বিজ্ঞাপন যার ফলে ট্রেনের কামড়ায় থাকা বিভিন্ন নির্দশাবলী ও ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে | পণ্য বা পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা ও ব্যবহারকারীর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে বিজ্ঞাপন ৷ বিজ্ঞাপন থেকেই কোন পণ্য সম্পর্কে জানতে পারেন সাধারণ ক্রেতা | বহুজাতিক সংস্থা হিসাবে নানা পদ্ধতি বেছে নিলেও ক্ষুদ্র বা মাঝারি সংস্থাগুলি এইসব মাধ্যম বেছে নিতে সামর্থ হয় না ৷ বিজ্ঞাপনের মাধ্যম হিসাবে তারা ট্রেন , বাস , ট্রাম বা জনবহুল কোন স্থানকে বেছে নেয় তারা ৷ অনেক সময় এইসব বিজ্ঞাপণ বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে সাধারণের কাছে ৷ পণ্য পরিষেবার থেকেও যৌনতাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয় এইসব বিজ্ঞাপণে ৷ যার প্রতি আকৃষ্ঠ হচ্ছে কিশোর -কিশোরারা ৷ সন্তানদের প্রশ্নে অনেক সময় অসস্তিতে পড়তে হয় বাবা মা কে ৷ বিজ্ঞাপনের প্রলোভনে পা দিয়ে স্বর্বসান্ত হচেছ অনেকেই i বিদেশে চাকরির বিজ্ঞাপনের টোপে পড়ে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে অনেক মেয়ে ৷ নিষিদ্ধ পল্লীর অন্ধকারে কাটাতে হচেছ সারা জীবন i দীর্ঘ দিন ধরে একই স্থানে বিজ্ঞাপন সাটতে ব্যবহার করা আঠায় মরিচা পড়ে নষ্ঠ হচ্ছে যানবাহন , দূষিত হচ্ছে সমাজ ৷ সচেতন হতে হবে মানুষকে । মানুষ সচেতন হলেই বন্ধ হবে নোংরামি ৷ বাঁচবে সম্পত্তি | নাহলে নোংরা বিজ্ঞাপনে প্রভাবিত হয়ে পঙ্গু হয়ে যাবে সমাজ ৷

–কুন্তল পাল

Wednesday, February 12, 2020

দুগগা দুগগা......... যেন নজর না লাগে


দুগগা দুগগা......... যেন নজর না লাগে

দুগগা দুগগা......... !  আরও কি যেন বিড় বিড় করে বলেই চলেছেন মা । গাড়িতে উঠে হাত নেড়ে ছেলে বলে উঠলো ,' মা আমি যাচ্ছি ।' মা বলে উঠলেন যাচ্ছি বলতে নেই , আসছি বলতে হই । সাঠ সাঠ , বালাই সাঠ । 

ছোট ছেলেটি কাকু বলে ডেকেছে কি, সাথে সাথে ঠাকুমা বলে উঠলেন - পিছন থেকে ডাকতে নেই, কি হয়েছে আমায় বল । রাস্তাই বেরোলে কোথায় কি হই তার ঠিক আছে ?
এমনই কত কুসংস্কার এ আবদ্ধ আমদের সমাজ । এই বেড়াজাল থেকে বেরোতে পারিনি আমরা । পারিনি আমিও । ভয় হয় যদি .........।
এইতো সেদিন পাশের বাড়ির মেয়েটা বলল , বৌদি সনুকে নিয়ে বাইরে যাব ? বৌদি বলল , দাঁড়াও , কপালে একটু কাজলের টিপ দিয়ে দিই । কাজলের টিপের উপর সাদা পাউডার । মাথার বা পাশেও একটু কাজলের টিপ । বাইরে যাবার সময় বাম হাতের কড়ে আঙুলের নখে কামড় কপালে ঠেকিয়ে বললেন দুগগা দুগগা.........।
স্নানের পর ভিজে গামছা রোদে মেলে দিতেই মায়ের বকুনি........
--- কতবার বলেছি ভিজে গামছা রোদে মেলতে নেই । তবুও সেই রোদেই মেলবে ।
--- কেন ? কি হয়, রোদে মেললে ?
--- কি হয় তোমার জানতে হবে না । বারন করেছি মেলবে না । কিছু মানো না বলেই তো এই অবস্থা । দিন দিন কি চেহারা হয়েছে । সন্ধ্যা হয়েছে এবার চুলটা বেঁধে নাও । সন্ধ্যা বেলা চুল ছেড়ে রাখতে নেই ।
ইস ...., দাঁড়াও । এখানে বসো । হাঁচি দেবার আর সময় পেলো না । সাবধানে যাবে । রাস্তায় অসুবিধা হলে দাঁড়িয়ে যাবে ।
--- কি হল ? আবার দাঁড়ালে কেন ?
--- সামনে একটা কালো বিড়াল চলে গেল ।
     আজ কি যে হল আমাদের , এমনিতে আজ শনিবার । দোকানে গিয়ে আগে লেবু-লঙ্কা ঝোলাবে । মোড়ের মাথায় শনি মন্দিরে ফুল দিয়ে নমস্কার করে যেও । দিন কাল ভাল না, কখন যে কি হয় কে জানে ? উঠোনের অত সুন্দর নারকেল গাছটা কিভাবে শুকিয়ে গেল । কেউ বান না মারলে এভাবে মরে তরতাজা গাছ ? সামনে ভাল একটা দিন দেখে বাড়ির ভিত পুজোটা সেরে ফেলতে হবে । মনে করে আগে একটা ভাঙ্গা কুলো, ঝাঁটা, জুতো উঁচু করে টাঙিয়ে দেবে । আমাদের তো খুব ভাল কপাল .......।
বালায় সাঠ, আর বসার জায়গা পেল না । সকাল বেলা বাড়ির চালে বসে কা.. কা.. করছে । হুঁশ.. ভাগ । কদিন ধরে মনটা খারাপ লাগছে । কি জানি , কি খারাপ খবর আসে । দুগগা.. দুগগা..। যা ...যা... যা ....। আঁচানোর আর জায়গা পেল না বিড়ালটা । ঘরের সামনেই এসে আঁচানোর  দরকার ওর ।
ছেলেটা বললে শোনে না । কতবার বলেছি পরীক্ষা দিতে যাবার আগে ডিম খেতে নেই । পরীক্ষায় গোল্লা পাবি তখন বুঝবি ।
--- শোনো আজ কিন্তু একটু মন্দিরে যাব ।
--- কেন ? আজ তো বুধবার । তুমি তো শনি-মঙ্গলবার মন্দিরে যাও ।
--- ছেলেটারও পরীক্ষা চলছে , তার উপর আজ ভোরে একটা বাজে স্বপ্ন দেখলাম । শুনেছি ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয় । তাই একটু মানত করে আসবো । শনিবারেই পুজোটা দিয়ে দেবো ।
হ্যাঁ , এসব আমাদের সমাজের কিছু কুসংস্কার , নিয়ম । যা প্রাচীনকাল থেকে মেনে আসছি আমরা । বড় বট গাছের নীচে অথবা কোর্ট চত্বরে প্রায় দেখা যাই জটলা হয়ে মানুষের ভিড় । আজও সেখান দিয়ে আসার সময় দাঁড়িয়ে পড়েন অনেকেই । কাঁচের বিভিন্ন পাত্রে গাছের ছাল-বাকল কিংবা বিভিন্ন ফল নিয়ে পসরা জমান কোন বুজরুকি বাবা । যার আসল লক্ষ্যই হল মানুষকে বোকা বানিয়ে পয়সা রোজগার করা । বিভিন্ন জটিল, কঠিন রোগ থেকে মোটা বা রোগা হবার উপায় কিংবা ফর্সা হবার নানা বুজরুকি কৌশল তার নখদর্পণে । কাউকে কুনজর থেকে রক্ষা করা অথবা ভেঙ্গে যাওয়া বিয়ে বা দাম্পত্ত্য কলহ অবলীলায় সমাধান করেন এই বুজরুকি বাবা । হাটে - বাজারে হামেশাই দেখা যাই এদের । সাপের বিষের মাদুলি , অষ্টধাতুর আংটি , শিকড়-বাকল কোনো কিছুই বাদ যাই না । আংটি ও শিকড় এর ভাড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ানোই চ্যালেঞ্জ হয়ে যায় সন্তানদের কাছে । সন্তানদের ভালো রাখতে প্রতিদিন বদল হয় জ্যোতিষীর চেম্বারের ঠিকানা । কে বেশি ভাল , কার কথা বেশি কাজে আসে , তা নিয়ে চলে চুলচেরা বিশ্লেষণ । সন্তানদের ভাল রাখতে গিয়ে কল্পনার জগতে পা রাখেন বাবা- মায়েরা । বাস্তব থেকে দূরে সরিয়ে দেন সন্তানদের । একটাই প্রার্থনা সন্তান যেন ভাল থাকে । যেন নজর না লাগে , দুগগা .. দুগগা...।
শেষ.......

কুন্তল পাল 

Saturday, February 8, 2020

আগের মত আর শান্তি নেই !


সত্যি কথা কি জানেন দাদা , ' আগের মত আর শান্তি নেই '! বাবার হাত ধরে গাড়ির লাইনে আসা ৷ বাবার সাথে ঘুরে বেড়িয়েছি এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত | কখনও গভীর জঙ্গল , কখনও ফাঁকা মাঠের মধ্য দিয়ে হাইওয়ে পেরিয়ে ছুটেছে গাড়ি | কখনও সমস্যা হয়নি I এখন প্রতি মূহুর্তে ভয় হয় ৷ এই বুঝি বিপদ এলো ৷ এই তো কিছুদিন আগে গাড়ি দাঁড় করিয়ে একটি কাগজ হাতে ধরিয়ে দিল কয়েকটি ছেলে ৷ মোটা টাকা দাবি করল ৷ দাবি মেনে টাকা দিতে আস্বীকার করায় অকথ্য গালাগালি ৷ বাধ্য হয়ে টাকা দিতেই হল ৷ আগেও রাস্তায় চাঁদা দিয়েছি ! এখনও দিই! সত্যি কথা কি _
                      ' আগের মত আর শান্তি নেই '!
     
       চাকরির আশায় বহু ঘুরেছি ৷ যেখানে আশ্বাস পেয়েছি সেখানেই ছুটে গিয়েছি ৷ চাকরি হয় নি | শেষ মেশ বউয়ের ও মায়ের শেষ সম্বল টুকু বিক্রি করে একটা গাড়ি কিনেছি ৷ এটা চলে গেলে সব শেষ | দয়া করে এটার দিকে কেউ নজর দেবেন না ৷ গাড়িটার দিকে তাকিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেন | রাগ হয় , কিছু বলতে পারি না ৷ মনে মনে একটা কথা বলি _
       ' বুড়ি নজর বালে তেরা মু কালা '

      অন্যের ভালো দেখে হিংসা করা এক শ্রেণীর মানুষের স্বভাব ৷ এদের কোন কাজ নেই ৷ একটাই কাজ, হিংসা আর সমালোচনা ৷ কেউ এগিয়ে যাচ্ছে দেখলেই টেনে ধরবে ৷ কিন্তু কেন ? কেন এত হিংসা ?
      ' হিংসা করো না , চেষ্টা করো তোমারও হবে '

      হিংসা করে লাভ কি ? কপালে যেটা থাকবে সেটাই হবে ৷ ঈশ্বরের দেওয়া কপাল কেউ কেড়ে নিতে পারে ? হিংসা করো না , হিংসা করলে বলবো_
              ' তোমার হিংসা , আমার জয় '

       এই জয় তোমাকে একদিন এমন জায়গায় পৌঁছে দেবে যে , এই মানুষগুলির কাছে তা ধরা ছোঁয়ার বাইরে ৷ তখন _
       ' দেখবি আর জ্বলবি,লুচির মত ফুলবি'

     গাড়িটাই আমার সব । খুব শখের । আজও আগলে রেখেছি ৷ কোন আঘাত লাগতে দিই না ৷ যেমন করে ১২ বছরের প্রেম আগলে বিয়ে করেছিলাম । আজও আমাদের একই ভালোবাসা । সত্যি কথা কি জানেন _
               ' প্রেম যদি সঠিক হয়
                        ভালোবাসা চিরদিন রয় '

      আরে বাবা কে নজর দিল , কে হিংসা করল , এসব ভেবে লাভ কি ? মোদ্দাকথা কাজ করতে হবে আনন্দের সাথে ...। যে কাজে আনন্দ নেই সে কাজে সাফল্য নেই ৷ এই দেখো না আমার গাড়ি এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ছুটে বেড়ায় ৷ কত মানুষ আনন্দ পায় ৷ কেউ গুন গুন করে ..
         'পাগলু থোরাসা করলে রোমান্স '

       আনন্দে থাকলে রোগ থেকে মুক্তি পাবেন ৷ এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়ান । ঘরে বসে মন খারাপ করে কি হবে ? সবাইকে একটা কথা বলি ...
              'মনে আনন্দ , মুখে হাসি
                    চলুন যাই বেড়িয়ে আসি । '

       দিদি ভাড়াটা দিন । কতবার চাইতে হবে ? তাড়াতাড়ি করুন ..
           ' দিচ্ছি দিচ্ছি করবেন না '

      ভিড় হয়ে যাবে ৷ একা সামলাতে হয় এমাথা ওমাথা ৷ আপনারা কিছু মানুষ আছেন , যাদের পয়সা দিতে গেলেই যত সমস্যা । একটা কথা জানবেন ...
         'আপনার ব্যবহারই আপনার পরিচয় '

      তিনটে টিকিট কেন ? ওই বাচ্চাটার ভাড়া কে দেবে ? না না ও বললে হবে না ...
         'তিন বৎসরের উর্দ্ধে পুরা ভাড়া লাগিবে '

      আরে দাদা বাসে উঠলেই ভাড়া লাগবে ৷ সামনে নামুন , আর দুরে ...
            'বাসে পা দিলেই পাঁচ '

      কাজে নেবার আগে মালিক একটা কথা বলে দিয়েছে ...
            'ব্যবসা গাড়িতে, বন্ধুত্ব বাড়িতে '

       ভাড়া নিয়ে ঝামেলা আর ভালো লাগে না ৷ কম দিতে পারলেই যেন শান্তি পায় । এর থেকে নিস্তার নেই | দু-এক দিন হলে হয় ....
               'জন্ম থেকে জ্বলছি '

       এত তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়লে হবে ? সংগ্রাম করতে হবে ৷ কত সমস্যা। তার উপর যানজট ৷ পিছিয়ে গেলে চলবে না ..
           'ভয় কিরে পাগল , আমি তো আছি '
   
      ওই কথাটা দেখছি সত্যি ৷ এখন বুঝতে পারছি বউয়ের সাথে মায়ের ঝগড়ার কারণ | যেমনটি পাশের বাড়িতেও লেগে আছে ৷ সত্যি বলতে কি ....
   ' যে মেয়ে শ্বশুর বাড়িতে বাপের বাড়ির কথায় মত্ত
             শ্বশুর বাড়িতে ঘর করা তার পক্ষে শক্ত '

     এভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন কেন ? একটু হলেই তো লোকটা সাইকেল থেকে পড়ে যেত ! ড্রাইভারদেরও তো একটা দায়িত্ব থাকে ৷ গাড়ির পিছনে তো লিখে রেখেছেন ....
              'কিসের এত তাড়াতাড়ি
              নিয়ম মেনে চালাও গাড়ি '

     'ট্রাফিক আইন মেনে চলুন'। এতে সকলেরই ভাল । বাড়িতে আপনাদেরও আপনজন রয়েছেন ৷ কিছু হয়ে গেলে কি হবে বলুন তো ......
           'সাবধানের মার নেই'!

     সবই জানি তবুও কিছু করার নেই । রাস্তায় বের হলেই ঝুঁকি ! কখন কি হয় ৷ এত রাতেও বাড়ি ফিরতে পারলাম না । মেয়েটা হয় তো ঘুমিয়ে পড়েছে । বেড়োনোর সময় বলেছিল .....
                    'বাবা চকোলেট এনো কিন্তু '

     নিজে খাই না খাই , বউ ছেলে-মেয়ের কথা তো ভাবতেই হবে ৷ খাটাখাটনি তো সব পেটের জন্যই । আমি আমার বন্ধুর মত হতে পারব না ৷ না খেয়ে ঘন্টার পর ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে যায় ৷ খাওয়ার কথা বললেই করুন স্বরে একটাই কথা ......
                 'বেশি খেলে মালিক বকবে'

     বেচারির কপালটাই খারাপ | ভালোবেসে বিয়ে করল , সংসার টিকলো না ৷ বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল ৷ গাড়িতে লেখাটা পড়লে মন খারাপ লাগে .....
              'দেখা হলে বালে দিও, আমি ভাল আছি '

     সেদিক থেকে আমি অনেক ভালো আছি । বউ, ছেলে - মেয়ে , বৃদ্ধা মাকে নিয়ে সংসার ...
               'এই বেশ ভালো আছি '

     আরে দাদা , গাড়ির কত দাম ? কোথা থেকে কিনলাম ? কিস্তি কত ? এসব আপনার জেনে লাভ কি ? গাড়িতে উঠেছেন ভাড়া দিন , গন্তব্যে নেমে পড়ুন । কথায় আছে....
              'আম খাও, আঁটি গুনো না '

     সারাদিন ঘুরে বেড়ালেই হয় না | কষ্ট করতে হয় | ভাবলাম আর হয়ে গেল তা না । গাড়িটা এমনি হয় নি ৷ খরচা করতে হয়েছে ...
               'দেখলে হবে , ঘরচা আছে '

ভেবে কি হবে ? ভেবে কিচ্ছু হবে না ৷ মোদ্দা কথা ....
                      'তুই কি পারবি ?'

     ভাড়া এক পয়সাও কম নিতে পারব না ৷ দিন দিন তেলের দাম বাড়ছে ৷ মাল বেশি হলে ভাড়া বেশি দিতেই হবে । অভাব সবারই আছে ৷ অভাব কখনও ঘোচেনা __
             'বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব
             তারও ছিল টাকার অভাব '

        রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার ম্যাজিক দেখার সময় নেই ৷ মাল খালি করে আবার লোড দিতে হবে ৷ গাড়ির কিস্তি তো দিতে হবে--
                    'তুই দেখ আমি যাই '

       এসি বাস , লং ট্যুর ৷ সামনে দৃষ্টি ৷ ভিতের দেখার সময় নেই ৷ যাত্রীদের জন্য মালিক নতুন টিভি বসিয়েছে ৷ এতে আমারও আনন্দ ৷ দেখো __
                  'তুমি দেখলে আমি খুশি '

      এই গাড়ির আয়েই সবার চলতে হয় ৷ মালিক নেবে, চালক নেবে , খালাসি নেবে ৷ অনেকটা __
                   'এক ফুল দুই মালি
                   ঊড়িষ্যায় লোড , বাংলায় খালি '

     ভাগ্যে না থাকলে হয় না ৷ একমাসে ৩ বার টায়ার গেল ৷ কপালটাই খারাপ । কথায় বলে –
                 'সিঁদুর পড়ে সব মেয়ে
                 কপাল গুনে চিক চিক করে '

      গাড়ি যখন চালায় কাউকে ভয় করি না । সৎভাবে রাস্তায় চলি | নিয়ম মেনে চলি , কাউকে তেল দিই না । আমার ভয় কিসের ?
                 ' ডানে শিব , বায়ে কালি
                 সকালে লোড , বিকালে খালি '

         সবসময় সব কথা বলা যায় না । কি বলতে কি বলি ...। রাস্তায় অন্যায় দেখেও অনেক সময় সইতে হয় । কথায় বলে ___
                'বহু কথায় বহু দোষ
                ভেবে চিন্তে কথা কোস '

       অনেক কথায় হল ৷ এগুলি কারও না কারও মনের কথা । রাস্তায় বের হলেই গাড়ির পিছনে লেখা দেখা যায় । কোনটা নীতিবাক্য , কোনটা আপ্তবাক্য , কোনটা নেহাতই মনের কথা ৷ যার মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে সমাজ ও মানব জীবনের নানান প্রতিচছবি ৷ ফুটে ওঠে ধর্মের ভন্ডামি , মানুষের ঔদ্ধত্ব , ক্ষোভ , প্রেম ভালোবাসা , জীবনের চাওয়া পাওয়া | তবে সবই রুচি -মানসিকতা-শিক্ষা-সংস্কৃতি -সামাজিক অবস্থানের উপর নির্ভর করে৷ এটাই আমাদের সমাজ | এটাই বৈচিত্র, বেঁচে থাকার আনন্দ : ....
                 '৮০ বন্ধু , আবার দেখা হবে '

..... শেষ 

      কুন্তল পাল


      

Friday, January 24, 2020

পরিবেশ বন্ধু শকুন

         
       দু দশক আগেও ছিল শকুনি গ্রাম বা শকুন পাড়া । একটা সময় ছিল যেখানে প্রতিটি গ্রামে কোথাও না কোথাও কোন গাছে বাস করত বিরাট আকারের শকুনের দল ৷ তাদের ত্যাগ করা বর্জে গাছের নীচে সাদা হয়ে থাকত ৷ অনেক সময় সাধারণকে ছাতা ব্যবহার করতে হত ৷ দুর্গন্ধে নাকে রুমাল দিতে বাধ্য হতেন সকলেই ৷ অনেকেই বিরক্ত হতেন | সন্ধ্যার পর আর শোনা যায় না শকুনের চিৎকার | এখন আর নেই শকুন পাড়া , নেই মানুষের বিরক্তি ৷ ৮০-র দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে কমতে শুরু করে বৃহৎ এই প্রাণী | বর্তমানে প্রায় ৮৭ শতাংশ কমে গিয়েছে চরে খাওয়া মাংসাশী প্রাণীটি ৷ মানুষের ঘৃণা ও অবেহলায় বিলুপ্তির পথে উপকারী ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষাকারী শকুন । তবে সাম্প্রতিককালে শকুনের উপকারিতা উপলব্ধি করেছে মানুষ । তাইতো আজ বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে শকুন দিবস (৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস ) । আন্টার্টিকা ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ বাদ দিলে বিশ্বের প্রায় সর্বত্র শকুন দেখা যায় ৷ সারা বিশ্বে ৩০ এরও বেশি প্রজাতির শকুন রয়েছে ৷ এদেরকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয় , নববিশ্বের শকুন ও পুরানো বিশ্বের শকুন ৷
          খাবারের জন্য পরিবেশের ময়লা আবর্জন সাফ করে নেয় শকুন । এমন কি চামড়া ও মাংস খেয়ে কঙ্কালে পরিণত করে অবশিষ্ট দেহাবশেষ ৷ যে কারণে এদের কে পরিবেশের বন্ধু বলা হয় । শকুনই একমাত্র প্রাণী , যারা পশু হত্যা করেনা । খাবারের জন্য পশুর মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করে | ১৮০০ সাল থেকে শকুনকে উপকারী হিসাবে গণ্য করা শুরু হয় ৷ মরা পশুর শরীর থেকে জীবানু ছড়ানো রোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এরা ৷ পরিবেশবিদদের মতে বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় অত্যন্ত উপকারী এই প্রাণী । পশুর শরীরে অ্যানথ্রাক্স , জলাতঙ্ক প্রভৃতি রোগ দিন দিন বেড়েই চলেছে ৷ যা ছড়িয়ে পড়ছে মানব শরীরেও | প্রখর হজম শক্তি হওয়ায় শকুন অ্যানথ্রাক্স , জলাতঙ্ক , বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ , গবাদি পশুর শরীরের বিভিন্ন জীবানু সহজেই হজম করতে পারে ৷ শকুনের ত্যাগ করা মলে শক্তিশালী অ্যাসিড উৎপন্ন হয় ৷ প্রখর হজম শক্তিতে উৎপন্ন হওয়া অ্যাসিড জীবাণু ও ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে সক্ষম ৷ যেটা ঢেঙ্গা নামক এক প্রকার পাখির মলে থাকে ৷
          শকুন প্রখর দৃষ্টিশক্তির অধিকারী | বহু উপর থেকে এরা খাবার লক্ষ করে । উন্মুক্ত সমতল থেকে ৪ মাইল দুরের ৩ ফুট আকারের বস্তুকেউ এরা পরিস্কার দেখতে পায় । শকুন খুবই আনুগত্য হয় , পরিবারের সাথে দীর্ঘ দিন আবদ্ধ থাকে ৷ বাচ্চা জন্মানোর পর প্রায় ৮ মাস তাদের দায়িত্ব পালন করে ৷ বিশ্রামের সময়ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখে | সাধারণত ১০ থেকে ১৫ বছর গড় হিসাবে বাঁচে এরা (কালো শকুন.) | একটি পূর্ণবয়স্ক শকুন প্রায় ৭৬ থেকে ১২২ সেমি লম্বা হয় | ডানা প্রায় ৩ মিটার , লেজ ১৬ - ২১ সেমি হয় ৷ মাথা ও গলায় কোন পালক থাকে না । এরা কাউকে আক্রমন করে না ঠিকই , তবে নিজেরা আক্রান্ত হলে পায়ের এক বিশেষ অঙ্গ দিয়ে আক্রমণ করে ( যে অঙ্গ খাবার সাফ করতে ব্যবহার হয় ) | নতুন পাতা দিয়ে বাসা বেধে ডিম পারে এরা.। বছরে এক বারই ডিম পারে ৷ কোন কারনে ডিম ভেঙে গেলে বাসাও ভেঙে ফেলে এরা ৷
          বিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে শকুন রোগ ছড়াচ্ছে বলে দাবি ওঠে ৷ হাতিয়ার হিসাবে একটি মহামারিকে সামনে রাখা হয় । সেই দাবি অনুসারে বিষ প্রয়োগ ও গুলি করে হাজার হাজার শকুন মেরে ফেলা হয় । গত কয়েক দশকে ভারতেও কমেছে শকুন | প্রায় ৯৮ শতাংশ শকুন কমেছে ভারতে ৷
          শকুন কমে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল ড্রাগ ৷ ডাইক্লোফেন , যা পশুর শরীরে অতিমাত্রায় প্রয়োগের ফলে বিষক্রিয়া ঘটছে শকুনের শরীরে ৷ ফলে কিডনির অসুখে ভুগে মারা যাচ্ছে এরা ৷ খাদ্যের ঘাটতিও অন্যতম কারন । বাসা বাধারও গাছের অভাব , ফলে প্রজননে বাধা পাচ্ছে | এককথায় পরিবেশই শকুনের কাছে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে I বিশেষজ্ঞদের ধারনা , বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী প্রাণী শকুন ক্রমশ হ্রাস পেলে নষ্ট হতে পারে সামগ্রিক প্রাণীজগতের বৈচিত্র I
          ...কুন্তল পাল
          

হারিয়ে যাচ্ছে কলমি , কুলেখাঁড়া , শুশনি

       
  ' বাগদী বুড়ি চুবড়ি ভরে নিয়ে / শাক তুলছে পুকুর পাড়ে বসে ' – বাগদী বুড়ির শাক তোলার দিন ফুরিয়েছে ৷ পুকুর পাড়ই হারিয়ে গিয়েছে | হারিয়ে গিয়েছে দেশি কলমি , কুলে খাঁড়া , শুশনি শাক । বদ্ধ জলাশয় , পুকুর , খাল বিল , নদী কোথাও আজ আর সেভাবে দেখা মেলে না এই সব শাক ৷ সব জায়গায় দখল নিয়েছে কচুরিপানা ৷ কচুরিপানার দাপটে নদীও হারাচ্ছে তার স্রোত | জেলেরাও তাদের পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন ৷ ইছামতি , কপোতাক্ষ , কোদালিয়া , গড়াইল , নাওভাঙা প্রভৃতি নদী আজ বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়েছে ৷ কচুরিপানায় আবদ্ধ হয়ে নদী হারিয়েছে তার স্রোত ৷ এইসব নদীতে আর জম্মায়না কলমি | অথচ এইসব নদীতেই একসময় খেলা করত কলমির কচি ডগা ৷
বিকাল বেলা গ্রামের মেয়ে -বৌয়েরা নদীর দুধারে শাক তুলত ৷ মাঠের জলের নালায় বেড়ে উঠত কত অজানা শাক ।এসব আজ অতীত ।
             কচুরিপানা অত্যন্ত লড়াকু মানসিকতার উদ্ভিদ ৷ দ্রুত বংশ বিস্তার করে এরা | এরা এতটাই আগ্রাসী যে এদের আশেপাশে কোন উদ্ভিদ জম্মাতে পারে না ৷ সেকারনেই যেসব জলাশয়ে কচুরিপানা রয়েছে সেখান থেকে হারিয়ে যাচ্ছে কলমি , কুলেখাঁড়া । চাষে অনিন্ত্রিত রাসায়নিক ব্যবহারে মাঠ থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে এই সব শাক ।

            কুন্তল পাল 

Thursday, January 23, 2020

বিপন্ন রাজ্যপশু বাঘরোল

       একদিন সকালে এলাকায় দেখা মেলে এক জন্তুর ৷ মৃত অবস্থাতেই পড়ে থাকতে দেখা যায় ৷ অনেকটা বাঘের মত দেখতে জন্তুটাকে নিয়ে নানা গুজব শুরু হয় ৷ পরে জানা যায় এটাই আমাদের রাজ্যপশু বাঘরোল ৷ এলাকায় কিছুদিন ধরে চুরি যাচ্ছিল হাঁস , মুরগি ৷ দিশেহারা হয়ে গ্রামের লোকজন ফাঁদও পাতেন | ফাঁদ ছিঁড়ে শিকার নিয়ে পালায় শিকারী ৷ প্রথমে সন্দেহ হয় শিয়ালের উপর ৷ কিন্তু ফাঁদের পাশে বাঘের মত পায়ের ছাপ সন্দেহ বদলে দেয় । তা হলে কি এলাকায় বাঘ ? আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এলাকাবাসী । এলাকার এক ব্যক্তির পোষা রাজহাঁস নিয়ে পালানোর চেষ্টা করে একটি জন্তু | তাড়া খেয়ে শিকার ফেলে পালিয়ে যায় । মৃত রাজহাঁসটিতে বিষ মিশিয়ে সেখানেই ফেলে রাখেন তিনি ৷ পর দিনই এলাকায় মৃত অবস্থায় ওই জন্তুটিকে পাওয়া যায় ৷ জন্তুটি ছিল বাঘরোল । কয়েক বছর আগে ঘটনাটি ঘটে উত্তর ২৪ পরগণার বাগদা থানার নৃসিংহখোলা এলাকায় ৷ এর দুদিন বাদেই এলাকার একটি ভেড়ির পাশ থেকে উদ্ধার হয়  বাঘরোল শাবক । চিতাবাঘের মত দেখতে শাবকটিকে বাড়িতে নিয়ে আসেন এক যুবক ৷ প্রাণীটি বাড়িতে রাখা বেআইনি জানাতে পেরে বনদপ্তরে খবর দেয় । জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন বন আধিকারিকরা ৷ আবারও লোকালয়ে চলে আসে শাবকটি ৷ অচেনা জন্তুটিকে কামড়ে মেরে ফেলে এলাকার কুকুর |
     
        এভাবে নানা কারনেই হারিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপশু বাঘরোল | সাধারণ বিড়ালের দ্বিগুণ আকার ও শক্তিশালী এই পশুটিকে অনেকেই মাছ ধরা বিড়াল বা মোছা বিড়াল নামে চেনেন | চলতি নাম হিসাবে বাঘডাশা , কুপায়া বাঘ প্রভৃতি নামেও পরিচিত ৷ প্রাণীবিদ্যায় Prionailurus Viverrinus নামে পরিচিত ৷ বাসস্থান Animalia . শুধুমাত্র ভারত নয় ৷ নেপাল , বাংলাদেশ , শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম , থাইল্যান্ড , বার্মা ,চিন , পাকিস্তান , ইন্দোনেশিয়া দ্বীপ এবং সুমাত্রা দ্বীপেও দেখা যায় বাঘরোল | ভারতীয় হিমালয় অঞ্চলে ১৫০০ থেকে ২১০০ মিটার উঁচুতেও দেখা মেলে রাজ্য পশু ৷ ৬৫ থেকে ৮৬ সেমি লম্বা ও ৫ থেকে ১৬ কেজি পর্যন্ত ওজন হয় ৷ লেজের আকার প্রায় ২৪ থেকে ৩৫সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয় ৷ উচ্চতা ৩০থেকে ৫৫ সেন্টিমিটার । শরীর ধূসর বর্ণের লোমে ঢাকা ৷ গায়ে লম্বালম্বি দাগ কাটা , মাঝে মাঝে কালো -বাদামি ছোপ ৷ চোখ ঈষৎ হলুদ , আলো পড়লে সবুজ আভা লক্ষ করা যায় ৷ এরা খুব ভালো সাঁতার কাটতে পারে ৷ দৌড়াতেও পটু , ঘন্টায় ৫৫ কিমি বেগে দৌড়াতে পারে ৷ এদের জীবনকাল খুবই সংক্ষিপ্ত ৷ মাত্র ১০-১৫ বছর বাঁচে এরা | মোটামুটি ৯ থেকে ১৮ মাস বয়সেই এরা সঙ্গমে লিপ্ত হয় । গর্ভধারণের প্রক্রিয়া ৬৩ থেকে ৭০ দিনে শেষ হয় | জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে এরা বাচ্চা প্রসব করে ৷ একটি মেয়ে বাঘরোল একসাথে ২-৩ টি বাচ্চা প্রসব করে | ১৬ দিন বয়সে চোখ ফোটে | দু মাস বয়স হলেই মাংস খাওয়া শুরু করে ৷ ৮-৯ মাসেই প্রাপ্তবয়স্ক ৷ ১২ থেকে ১৮ মাসে পুরোপুরি যুবক | রাত জেগে শিকার করার পর দিন এরা ঘন জঙ্গলে কাটায় । মুখে একপ্রকার আওয়াজ করে নিজেদের জানান দেয়৷
       
         এই জন্তুটিই আজ বিপন্ন ! The International Union for Conservation of Nature and Natural Resources ( IUCN ) , ২০১০ সালে এই প্রাণীটিকে বিপন্ন প্রাণী হিসাবে ঘোষণা করেছে । বন্যপ্রাণী আইন ১৯৭২ অনুসারেও বাঘরোল লুপ্তপ্রায় প্রাণী ৷ এদেরকে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন ৷ পরিবেশের সামঞ্জস্য বজায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে বাঘরোল ৷ সরকারি ভাবে কড়া পদক্ষেপ না নেওয়ায় দিন দিন কমছে বাঘরোলের সংখ্যা | বর্তমানে সারা দেশে মাত্র ৩ হাজার বাঘরোল রয়েছে ৷ বেশির ভাগই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে I যার সিংহভাগ হাওড়া জেলায় ৷ একসময় সুন্দরবনের জলাভূমি এলাকা , পূর্ব কলকাতার বিস্তৃর্ণ জলাভূমি ও হাওড়ায় প্রচুর পরিমানে বাঘরোল দেখা যেত । সাম্প্রতিক কালে সুন্দরবনের বেশির ভাগ এলাকা বাঘের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে , বাকি জায়গায় গজিয়ে উঠেছে বাসস্থান | কলকাতা হাওড়াতেও জলাভূমি বুজিয়ে বহুতল গড়ে উঠেছে,ফলে ওদের বাসস্থান ও আশ্রয়ের অভাব দেখা দিয়েছে ৷ এছাড়াও চোরাশিকারির দ্বারা আক্রান্ত হয়েও কমছে সংখ্যাটা ৷ মাছ এদের প্রিয় খাদ্য হলেও প্রচুর পরিমানে ইঁদুর খেয়ে এরা চাষে উপকার করে ৷ এছাড়াও নানা প্রকার সরীসৃপ, পাখি প্রভৃতি এদের খাদ্য |
       
       বাঘরোল কে বাঘের সমগোত্রীয় তুলনা করা হয় ৷ যদিও একটি বাঘকে বাঁচাতে সরকারী ভাবে যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় তার বিন্দু মাত্র উদ্যোগ নেওয়া হয় না বাঘরোলকে বাঁচাতে | আমাদেরকে উদ্যোগী হতে হবে৷ রাজ্য পশুকে বাঁচাতে পারলে এক দিকে যেমন চাষবাসে উপকার হবে , তেমনই রক্ষা হবে জীব বৈচিত্র । এরা বাঁচলেই রক্ষা হবে খাদ্য-খাদক শৃঙ্খল , বাঁচব আমরা ৷
                          ........শেষ
      কুন্তল পাল

Thursday, January 16, 2020

স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আস্তাবল শূন্য মঙ্গলগঞ্জ


           আস্তাবল শূন্য হয়েছে অনেক আগেই ৷ বর্তমানে আস্তাবলের কোন চিহ্নই আজ আর নেই ৷ অতীতের সেসব গল্প শুনে আজ কেউই বিশ্বাস করবে না , এখানেই ছিল বিরাট আস্তাবল | ছিল নহবত খানা , হেপাজতখানা, শিশু মহল , দরবার মহল , রাজমহল আরও কত প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন ৷ সে সবই আজ হারিয়ে গিয়েছে ৷ অতীত দিনের গৌরব হারিয়ে কঙ্কালসার ধ্বংসস্তুপের মত দাড়িঁয়ে আছে মঙ্গলগঞ্জের নীলকুঠী | কিছুদিন পর হয়ত শেষ স্মৃতি টুকুও ধুলোয় মিশে যাবে !

           উত্তর ২৪ পরগণার সীমান্তবর্তী বাগদা থানা | এই থানার অন্তর্গত মঙ্গলগঞ্জ একসময় ছিল দর্শনীয় স্থান ৷ ইছামতীর তীরে বিরাট এলাকা জুড়ে দাঁড়িয়ে নীলকুঠী । স্থানীয়রা অবশ্য 'সদন' নামেই জেনে এসেছে ৷ ইছামতীর একপাশে নীলকুঠী , অন্যপাশে বিভূতিভূষণ অভয়ারণ্য ৷ যেখানে রয়েছে রাজ্যের দ্বিতীয় ডিয়ার পার্ক |

           বিশাল এলাকা জুড়ে নীলচাষকে কেন্দ্র করে একসময় কর্মব্যস্ত ছিল নীলকুঠী । কালের নিয়মে ব্যস্ততা আজ আর নেই ৷ বিরাট কুঠীর সামান্য অংশ আজ বর্তমান | কয়েদ ঘরের তালা ভেঙে গিয়েছে অনেক আগেই । ঘরটিও আজ আর নেই ৷ নেই কাছাড়ি বাড়িটাও ৷ এখন শুধুই আগাছা ! অথচ এই কুঠীকে ঘিরেই ছিল কৃষ্ণচুড়া , রাধাচুড়া , বকুল, পলাশ , শিমূল আরও কত ফুল ফলের গাছ । এসব দেখতে দূর দুরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসত । আজ আর কেউ আসেনা ৷ বিষাক্ত সাপ আর বন্যজন্তুদের আস্তানা মঙ্গলগঞ্জে আজ বিষাদের সুর ৷

           অতীতদিনের দুএক জন ছাড়া মঙ্গলগঞ্জের ইতিহাস সম্পর্কে কারও তেমন ধারণা নেই | মঙ্গলগঞ্জের ইতিহাস জানতে বা জানাতে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি সরকার । দু-একটি বই থেকে কিছুটা জানা গেলেও নীলকুঠীর পুরো ইতিহাস অনেকেরই অজানা ৷ প্রায় ২০০ বছর আগে ভিত্তি পত্তন হয়েছিল নীলকুঠীর ৷ ৬৫ বিঘা জমিকে ঘিরে বিশাল নীলচাষ শুরু হয় । গোবরডাঙ্গার খাটুরা অঞ্চলের ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন মঙ্গলচন্দ্র আঁশ । অবিভক্ত বাংলায় ব্যবসায় খ্যাতি অর্জন করেছিলেন । বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহ থেকে সমগ্র যশোর জেলায় তাঁর ব্যবসা বিস্তার ছিল ৷ মঙ্গলচন্দ্রের পুত্র লক্ষণ চন্দ্র আঁশ | বারশালের বিধবাকে দ্বিতীয় বার বিয়ে করায় বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হ্য় লক্ষণ চন্দ্রের। সম্পর্ক ছিন্ন করার সময় ছেলেকে প্রচুর সম্পত্তি দেন মঙ্গলচন্দ্র | সেই সময় মঙ্গলগঞ্জের জমিদার ছিলেন কোন এক ঘোষ বাবু | ব্যবসায় সুবিধা করতে না পারায় নগদ অর্থের বিনিময়ে লক্ষণচন্দ্রকে জমিদারি হস্তান্তর করেন তিনি ৷ বাবার নাম অনুসারে এখানকার নাম রাখেন মঙ্গলগঞ্জ । ইছামতীর তীরে বিশাল জমি দেখে ভালো লেগে যায় লক্ষণ চন্দ্রের | সাহেব কোপানির সাথে যোগাযোগ করে পত্তন করলেন নীলকুঠী | সেখানকার রাজা হলেন লক্ষণচন্দ্র আঁশ । মাত্র ১০ বছর রাজত্ব করে মারা যান রাজা | একে একে মারা যান ৩ মেয়ে ও ২ ছেলে ৷ শেষ পর্যন্ত ছোট মেয়েই বেঁচে ছিলেন | এলাকায় পিসিমা নামে পরিচিত ছিলেন তিনি ৷

           এখানেই গড়ে উঠেছিল নীলের গুদামঘর , নীলপচানের চৌবাচ্চা ৷ যদিও এখন তার চিহ্নমাত্র নেই৷১৯০৩ সালে গুদামঘরে প্রাইমারি স্কুলের প্রতিষ্ঠা হয় ৷ পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালে একটি ঘরে পোস্ট অফিসের অনুমোদন দেন পিসীমা সাবিত্রী আঁশ | তাঁর সাথে পরিচয় ছিল তৎকালীন কালিম্পং এর এম পি মৈত্রী বোসের ৷ তাঁর সাথে আলোচনা করে বিরাট এই এলাকা ভারত সরকার পরিচালিত 'শিশুরক্ষা সমিতি'কে দান করেন সাবিত্রী আঁশ । মোটামুটি ষাটের দশকে সম্পত্তি দান করে এলাকা ছেড়ে চলে যান তিনি ৷ এরপর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনাথ ছেলে-মেয়েরা এখানে আসতে শুরু করে । তবে এখন আর নেই তারা।  ওই সমিতির বিরুদ্ধেও অভিযোগ ওঠে ৷ বিদেশ থেকে অনুদান সত্ত্বেও অভুক্ত থাকতে হত শিশুদের.৷

           জলপথে যোগাযোগের সুবিধা থাকায় অল্পদিনেই বিস্তার লাভ করে মঙ্গলগঞ্জের নীল চাষ । জলপথে উৎপাদিত নীল পাড়ি দিত বিভিন্ন দেশে । এলাকার সমস্থ চাষীকেই বাধ্য করা হত নীল চাষে । অবাধ্য চাষীদের উপর চলত নির্মম অত্যাচার | দেশ স্বাধীন হলে চলে যায় ইংরেজরা ৷ সদাব্যস্ত ও চোখ রাঙানির হাত থেকে রক্ষা পেয়ে শান্ত হয় নীলকুঠী । প্রাইমারি স্কুল ও কচিকাচাদের কোলাহলে নবজীবন ফিরে পায় মঙ্গলগঞ্জ ৷ ফুলে ফলে ভরা মঙ্গলগঞ্জে তখন শুধুই পাখির কলোরব | কালে কালে তা শেষ হতে থাকে ৷ এখন আর একটিও গাছ নেই স্বাক্ষ্য বহন করার জন্য I দু-এক টি যা আছে তা বর্তমান প্রজন্মের ৷ বিরাট শালবাগান চুরি হয়ে গিয়েছে ৷ দখলদারিতে কমে এসেছে বিরাট এলাকা। চুরি হয়েছে জমিদারির শ্বেত পাথরের টেবিল , রূপোর ফুলদানি , ঝাড়লণ্ঠন আরও কত কিছু |

           মঙ্গলগঞ্জের বিরাট এই এলাকাকে কেন্দ্র করে এখানেই গড়ে উঠতে পারত পর্যটন কেন্দ্র ৷ পড়ে থাকা বিরাট খেলার মাঠকে কেন্দ্র করে তৈরি হতে পারত স্পোটর্স কমপ্লেক্স ৷ সরকার উদ্যোগী হলে এখনও এখানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব ৷ পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠলেই মানুষজন আসবেন নীলকর সাহেবদের স্বাক্ষ্য বহনকারী মঙ্গলগঞ্জে ৷ আবারও কোলাহলে মেতে উঠবে নীলকুঠী , থাকবে না শুধুই ইংরেজদের চোখরাঙানি ৷
                ....শেষ।

.... কুন্তল পাল

Wednesday, January 15, 2020

মাঠের গাছ জ্বলছে ভাঁটায় , অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার লড়াইয়ে শিউলিরা








  " সবার চেয়ে খেতে ভালো পাউরুটি আর ঝোলা গুড় " ....

লাইনটা মনে পড়লেই মনে পড়ে শীত কালের কথা ৷ শীত মানেই খেজুর রস নলেন গুড় , পিঠে -পায়েস-পুলি | শীত মানেই জয়নগরের মোয়া | শীতের সকালে কাঁপতে কাঁপতে এক গ্লাস মিষ্টি খেজুর রসের তুলনা হয় না ৷ কাঠাল পাতায় গরম খেজুর গুড় মনে করিয়ে দেয় হারানো শীতের শৈশব ।



        যারা খেজুর রস ও নলেন গুড় তৈরি করে তাদের শিউলি বলে | হিন্দু সম্প্রদায় ভুক্ত প্রাচীন এক জাতি | প্রাচীনকাল থেকেই খেজুর গাছ থেকে রস বার করার কাজ করে আসছে ওরা | সেই রস থেকে গুড় ও তৈরি করে ৷ তবে তাদের আজ আর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে | এসেছে অন্যান্য জাতির মানুষ | বাধা পেয়েছে তাদের সাধের পেশা | এখন আর এই পেশায় কেউ আসে না ৷ যাকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকবে এই পেশা সেই খেজুর গাছই আজ আর দেখা যায় না ৷ সারি সারি মাঠের খেজুর গাছ পুড়ছে ভাটায় | অবশিষ্ট দুএকটি গাছ আঁকড়ে পেশাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার শিউলিরা ৷ আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হয় গাছ পরিস্কার করার কাজ I প্রথমে গাছ ঝোড়া | এরপর গাছে চাছ দেওয়া হয় | অগ্রহায়ন মাসে গাছে বসে কন্ঠনালি | সেই নালি দিয়েই বের হয় মিষ্টি রস | এক একটি করে গাছের শুকনো পাতা কেটে ফেলতে হবে সবার আগে ৷ বালিকাচায় ধার তুলে তুলে জুৎসই করে নিতে হবে ছ্যান ৷ সেই ধারালো ছ্যান দিয়ে গাছের আগা চেঁছে চেঁছে কন্ঠনালি বসাতে হবে ৷নলের মুখে বসাতে হবে


ভাঁড় , সেই ভাঁড়ে সারা রাত টুপ টুপ করে জমবে রস ৷ খেজুর গাছেরও লিঙ্গভেদ রয়েছে৷ মেয়ে গাছে রস বেশি হয় | পুরুষ গাছের তুলনায় মিষ্টিও হয় বেশি | কত বছর ধরে একটি গাছ রস দিচ্ছে তা গাছের গায়ে গাট গুনে বলে দেওয়া যায় ৷ কিছু কিছু গাছ কে রেস্ট বা জিরোতে দেওয়া হ্য় | মাঝে মাঝে কাটা হ্য় | সেকারণে সেইসব গাছের রসকে জিরেন রস বলে৷ সাধারণ রসের তুলনায় জিরেন রস মিষ্টি বেশি হয় ৷ রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করাও কষ্টসাধ্য কাজ | গুড় তৈরি হতে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে | গুড় সম্পূর্ণ হওয়ার ২০ মিনিট আগে তৈরি হয় নলেন গুড় ৷ এরপর ঝোলাগুড় , দানাগুড় , জিরেন গুড় , চিটেগুড় প্রভৃতি | গুড় তৈরি হয়েছে কিনা ,তা কড়াইয়ে 'বিচ মেরে ' বোঝা যায় ৷ নারকেল মালা ও বাঁশ দিয়ে তৈরি হয় গুড় তোলার পাত্র I নলেন গুড় ও পাটালির চাহিদা সবচেয়ে বেশি | রস জ্বালিয়ে কলাপাতার উপর জমানো হয় পাটালি ৷ এককাট , দোকাট , তেকাট রস হয় গাছ থেকে ৷ অনেকে আবার চৌকাট রস বের করে ৷এককাট রস দিয়ে তৈরি হয় নলেন গুড় ৷ দোকাট বা তে কাট রস দিয়ে তৈরি হয় ঝোলাগুড় ৷ এই গুড়ের স্বাদ কিছুটা টক হয় ৷ রস গুড়ে পরিনত হলেই স্বার্থক হবে "খেজমৎ মেহনৎ " |

        খেজুর রস থেকে তৈরি নলেন গুড় বাংলার মানিচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে প্রাচীনকালেই । নলেন গুড়ের সন্দেশ বা রসোগোল্লা গ্রাম থেকে শহর এমন কি বিদেশেও সুখ্যাতি লাভ করেছে ৷ নলেন গুড়ের পায়েসের তুলনায় হয় না | বাঙালির অতি প্রিয় জয়নগরের মোয়ার প্রধান উপকরণই নলেন গুড় । খেজুর রস কিছুটা জ্বালানোর পর লালচে হলে তাকে তাঁতরস বলে ৷ তাঁতরস দিয়ে মুড়ি খাওয়ার জন্য বাঙালি আজও অপেক্ষা করে থাকে ৷দল বেঁধে রস চুরি আজও গ্রামবাংলার কিশোর যুবকদের কাছে আনন্দের ৷ ভয়ে ভয়ে গাছে উঠে পাটকাঠির নলে ভাঁড়ের রস খাওয়ার মধ্যেই যেন আনন্দ খুঁজে পায় ওরা | তবে এটাকে চুরি বলতে নারাজ অনেকই । গাছের মালিকও এসবের মধ্যে নিজের শৈশবকে খোঁজার চেষ্টা করে৷ নরেন্দ্রনাথ মিত্রের লেখা 'রস' গল্পে বর্ণিত হয়েছে খেজুর রসের কাহিনী | জোয়ান মোতালেফ ও রাজেক মৃধার বিধবা স্ত্রী মাজু খাতুনের প্রেম কাহিনী | সিনেমাও তৈরি হয়েছে ৷ 'সওদাগর' সিনেমায় অমিতাভ বচ্চনের অভিনয় আজও দর্শকের মনকে টানে ৷
       
এত কিছুর মধ্যেও গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের পেশাকে বাঁচিয়ে রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে শিউলিরা | এক দিকে নতুন করে এই পেশায় না আসা , অন্যদিকে খেজুর গাছের অভাব । দুয়ে মিলে হারিয়ে যেতে বসেছে এই পেশা | গ্রাম বাংলার শিউলি দের গলায় হতাশার সুর " নতুন করে কোন পুলাপান আর আসছে না । নিজের পুলাও আর একাজ করতে চাইছে না । এখন আর কেউ খেজুর গাছেই উঠতে পারে না , পেশা বাচবে কেমনে ? " অনেকেই মাঠের খেজুর গাছ কেটে ভাটায় জ্বালানি হিসাবে বিক্রি করে দিচ্ছে মোটা টাকার লোভে । ফলে কমছে গাছ ৷

        এক সময় বাংলাদেশ থেকেও শীতের মরশুমে অনেক শিউলি আসত এই বাংলায় | আজ আর আসে না ! কমেছে গাছ , কমেছে শিউলি ৷ নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, উত্তর ২৪ পরগণা , দক্ষিণ ২৪ পরগণা , হাওড়া প্রভৃতি জেলায় আজও শিউলিদের দেখা যায় ঠিকই , তবে তাদের চোখে মুখে করুন আর্তি ... ' যেন না হারায় এই পেশা '| গাছির আদর গাছই বোঝে ৷ গাছের মালিকরা বুঝলে অস্তিত্ব বাঁচানোর লড়াইয়ে লড়তে হত না গ্রাম বাংলার শিউলিদের |  ..... শেষ 

.... কুন্তল পাল