সত্যি কথা কি জানেন দাদা , ' আগের মত আর শান্তি নেই '! বাবার হাত ধরে গাড়ির লাইনে আসা ৷ বাবার সাথে ঘুরে বেড়িয়েছি এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত | কখনও গভীর জঙ্গল , কখনও ফাঁকা মাঠের মধ্য দিয়ে হাইওয়ে পেরিয়ে ছুটেছে গাড়ি | কখনও সমস্যা হয়নি I এখন প্রতি মূহুর্তে ভয় হয় ৷ এই বুঝি বিপদ এলো ৷ এই তো কিছুদিন আগে গাড়ি দাঁড় করিয়ে একটি কাগজ হাতে ধরিয়ে দিল কয়েকটি ছেলে ৷ মোটা টাকা দাবি করল ৷ দাবি মেনে টাকা দিতে আস্বীকার করায় অকথ্য গালাগালি ৷ বাধ্য হয়ে টাকা দিতেই হল ৷ আগেও রাস্তায় চাঁদা দিয়েছি ! এখনও দিই! সত্যি কথা কি _
' আগের মত আর শান্তি নেই '!
চাকরির আশায় বহু ঘুরেছি ৷ যেখানে আশ্বাস পেয়েছি সেখানেই ছুটে গিয়েছি ৷ চাকরি হয় নি | শেষ মেশ বউয়ের ও মায়ের শেষ সম্বল টুকু বিক্রি করে একটা গাড়ি কিনেছি ৷ এটা চলে গেলে সব শেষ | দয়া করে এটার দিকে কেউ নজর দেবেন না ৷ গাড়িটার দিকে তাকিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেন | রাগ হয় , কিছু বলতে পারি না ৷ মনে মনে একটা কথা বলি _
' বুড়ি নজর বালে তেরা মু কালা '
অন্যের ভালো দেখে হিংসা করা এক শ্রেণীর মানুষের স্বভাব ৷ এদের কোন কাজ নেই ৷ একটাই কাজ, হিংসা আর সমালোচনা ৷ কেউ এগিয়ে যাচ্ছে দেখলেই টেনে ধরবে ৷ কিন্তু কেন ? কেন এত হিংসা ?
' হিংসা করো না , চেষ্টা করো তোমারও হবে '
হিংসা করে লাভ কি ? কপালে যেটা থাকবে সেটাই হবে ৷ ঈশ্বরের দেওয়া কপাল কেউ কেড়ে নিতে পারে ? হিংসা করো না , হিংসা করলে বলবো_
' তোমার হিংসা , আমার জয় '
এই জয় তোমাকে একদিন এমন জায়গায় পৌঁছে দেবে যে , এই মানুষগুলির কাছে তা ধরা ছোঁয়ার বাইরে ৷ তখন _
' দেখবি আর জ্বলবি,লুচির মত ফুলবি'
গাড়িটাই আমার সব । খুব শখের । আজও আগলে রেখেছি ৷ কোন আঘাত লাগতে দিই না ৷ যেমন করে ১২ বছরের প্রেম আগলে বিয়ে করেছিলাম । আজও আমাদের একই ভালোবাসা । সত্যি কথা কি জানেন _
' প্রেম যদি সঠিক হয়
ভালোবাসা চিরদিন রয় '
আরে বাবা কে নজর দিল , কে হিংসা করল , এসব ভেবে লাভ কি ? মোদ্দাকথা কাজ করতে হবে আনন্দের সাথে ...। যে কাজে আনন্দ নেই সে কাজে সাফল্য নেই ৷ এই দেখো না আমার গাড়ি এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ছুটে বেড়ায় ৷ কত মানুষ আনন্দ পায় ৷ কেউ গুন গুন করে ..
'পাগলু থোরাসা করলে রোমান্স '
আনন্দে থাকলে রোগ থেকে মুক্তি পাবেন ৷ এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়ান । ঘরে বসে মন খারাপ করে কি হবে ? সবাইকে একটা কথা বলি ...
'মনে আনন্দ , মুখে হাসি
চলুন যাই বেড়িয়ে আসি । '
দিদি ভাড়াটা দিন । কতবার চাইতে হবে ? তাড়াতাড়ি করুন ..
' দিচ্ছি দিচ্ছি করবেন না '
ভিড় হয়ে যাবে ৷ একা সামলাতে হয় এমাথা ওমাথা ৷ আপনারা কিছু মানুষ আছেন , যাদের পয়সা দিতে গেলেই যত সমস্যা । একটা কথা জানবেন ...
'আপনার ব্যবহারই আপনার পরিচয় '
তিনটে টিকিট কেন ? ওই বাচ্চাটার ভাড়া কে দেবে ? না না ও বললে হবে না ...
'তিন বৎসরের উর্দ্ধে পুরা ভাড়া লাগিবে '
আরে দাদা বাসে উঠলেই ভাড়া লাগবে ৷ সামনে নামুন , আর দুরে ...
'বাসে পা দিলেই পাঁচ '
কাজে নেবার আগে মালিক একটা কথা বলে দিয়েছে ...
'ব্যবসা গাড়িতে, বন্ধুত্ব বাড়িতে '
ভাড়া নিয়ে ঝামেলা আর ভালো লাগে না ৷ কম দিতে পারলেই যেন শান্তি পায় । এর থেকে নিস্তার নেই | দু-এক দিন হলে হয় ....
'জন্ম থেকে জ্বলছি '
এত তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়লে হবে ? সংগ্রাম করতে হবে ৷ কত সমস্যা। তার উপর যানজট ৷ পিছিয়ে গেলে চলবে না ..
'ভয় কিরে পাগল , আমি তো আছি '
ওই কথাটা দেখছি সত্যি ৷ এখন বুঝতে পারছি বউয়ের সাথে মায়ের ঝগড়ার কারণ | যেমনটি পাশের বাড়িতেও লেগে আছে ৷ সত্যি বলতে কি ....
' যে মেয়ে শ্বশুর বাড়িতে বাপের বাড়ির কথায় মত্ত
শ্বশুর বাড়িতে ঘর করা তার পক্ষে শক্ত '
এভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন কেন ? একটু হলেই তো লোকটা সাইকেল থেকে পড়ে যেত ! ড্রাইভারদেরও তো একটা দায়িত্ব থাকে ৷ গাড়ির পিছনে তো লিখে রেখেছেন ....
'কিসের এত তাড়াতাড়ি
নিয়ম মেনে চালাও গাড়ি '
'ট্রাফিক আইন মেনে চলুন'। এতে সকলেরই ভাল । বাড়িতে আপনাদেরও আপনজন রয়েছেন ৷ কিছু হয়ে গেলে কি হবে বলুন তো ......
'সাবধানের মার নেই'!
সবই জানি তবুও কিছু করার নেই । রাস্তায় বের হলেই ঝুঁকি ! কখন কি হয় ৷ এত রাতেও বাড়ি ফিরতে পারলাম না । মেয়েটা হয় তো ঘুমিয়ে পড়েছে । বেড়োনোর সময় বলেছিল .....
'বাবা চকোলেট এনো কিন্তু '
নিজে খাই না খাই , বউ ছেলে-মেয়ের কথা তো ভাবতেই হবে ৷ খাটাখাটনি তো সব পেটের জন্যই । আমি আমার বন্ধুর মত হতে পারব না ৷ না খেয়ে ঘন্টার পর ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে যায় ৷ খাওয়ার কথা বললেই করুন স্বরে একটাই কথা ......
'বেশি খেলে মালিক বকবে'
বেচারির কপালটাই খারাপ | ভালোবেসে বিয়ে করল , সংসার টিকলো না ৷ বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল ৷ গাড়িতে লেখাটা পড়লে মন খারাপ লাগে .....
'দেখা হলে বালে দিও, আমি ভাল আছি '
সেদিক থেকে আমি অনেক ভালো আছি । বউ, ছেলে - মেয়ে , বৃদ্ধা মাকে নিয়ে সংসার ...
'এই বেশ ভালো আছি '
আরে দাদা , গাড়ির কত দাম ? কোথা থেকে কিনলাম ? কিস্তি কত ? এসব আপনার জেনে লাভ কি ? গাড়িতে উঠেছেন ভাড়া দিন , গন্তব্যে নেমে পড়ুন । কথায় আছে....
'আম খাও, আঁটি গুনো না '
সারাদিন ঘুরে বেড়ালেই হয় না | কষ্ট করতে হয় | ভাবলাম আর হয়ে গেল তা না । গাড়িটা এমনি হয় নি ৷ খরচা করতে হয়েছে ...
'দেখলে হবে , ঘরচা আছে '
ভেবে কি হবে ? ভেবে কিচ্ছু হবে না ৷ মোদ্দা কথা ....
'তুই কি পারবি ?'
ভাড়া এক পয়সাও কম নিতে পারব না ৷ দিন দিন তেলের দাম বাড়ছে ৷ মাল বেশি হলে ভাড়া বেশি দিতেই হবে । অভাব সবারই আছে ৷ অভাব কখনও ঘোচেনা __
'বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব
তারও ছিল টাকার অভাব '
রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার ম্যাজিক দেখার সময় নেই ৷ মাল খালি করে আবার লোড দিতে হবে ৷ গাড়ির কিস্তি তো দিতে হবে--
'তুই দেখ আমি যাই '
এসি বাস , লং ট্যুর ৷ সামনে দৃষ্টি ৷ ভিতের দেখার সময় নেই ৷ যাত্রীদের জন্য মালিক নতুন টিভি বসিয়েছে ৷ এতে আমারও আনন্দ ৷ দেখো __
'তুমি দেখলে আমি খুশি '
এই গাড়ির আয়েই সবার চলতে হয় ৷ মালিক নেবে, চালক নেবে , খালাসি নেবে ৷ অনেকটা __
'এক ফুল দুই মালি
ঊড়িষ্যায় লোড , বাংলায় খালি '
ভাগ্যে না থাকলে হয় না ৷ একমাসে ৩ বার টায়ার গেল ৷ কপালটাই খারাপ । কথায় বলে –
'সিঁদুর পড়ে সব মেয়ে
কপাল গুনে চিক চিক করে '
গাড়ি যখন চালায় কাউকে ভয় করি না । সৎভাবে রাস্তায় চলি | নিয়ম মেনে চলি , কাউকে তেল দিই না । আমার ভয় কিসের ?
' ডানে শিব , বায়ে কালি
সকালে লোড , বিকালে খালি '
সবসময় সব কথা বলা যায় না । কি বলতে কি বলি ...। রাস্তায় অন্যায় দেখেও অনেক সময় সইতে হয় । কথায় বলে ___
'বহু কথায় বহু দোষ
ভেবে চিন্তে কথা কোস '
অনেক কথায় হল ৷ এগুলি কারও না কারও মনের কথা । রাস্তায় বের হলেই গাড়ির পিছনে লেখা দেখা যায় । কোনটা নীতিবাক্য , কোনটা আপ্তবাক্য , কোনটা নেহাতই মনের কথা ৷ যার মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে সমাজ ও মানব জীবনের নানান প্রতিচছবি ৷ ফুটে ওঠে ধর্মের ভন্ডামি , মানুষের ঔদ্ধত্ব , ক্ষোভ , প্রেম ভালোবাসা , জীবনের চাওয়া পাওয়া | তবে সবই রুচি -মানসিকতা-শিক্ষা-সংস্কৃতি -সামাজিক অবস্থানের উপর নির্ভর করে৷ এটাই আমাদের সমাজ | এটাই বৈচিত্র, বেঁচে থাকার আনন্দ : ....
'৮০ বন্ধু , আবার দেখা হবে '
..... শেষ
কুন্তল পাল
0 comments:
Post a Comment