Friday, January 24, 2020

পরিবেশ বন্ধু শকুন

         
       দু দশক আগেও ছিল শকুনি গ্রাম বা শকুন পাড়া । একটা সময় ছিল যেখানে প্রতিটি গ্রামে কোথাও না কোথাও কোন গাছে বাস করত বিরাট আকারের শকুনের দল ৷ তাদের ত্যাগ করা বর্জে গাছের নীচে সাদা হয়ে থাকত ৷ অনেক সময় সাধারণকে ছাতা ব্যবহার করতে হত ৷ দুর্গন্ধে নাকে রুমাল দিতে বাধ্য হতেন সকলেই ৷ অনেকেই বিরক্ত হতেন | সন্ধ্যার পর আর শোনা যায় না শকুনের চিৎকার | এখন আর নেই শকুন পাড়া , নেই মানুষের বিরক্তি ৷ ৮০-র দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে কমতে শুরু করে বৃহৎ এই প্রাণী | বর্তমানে প্রায় ৮৭ শতাংশ কমে গিয়েছে চরে খাওয়া মাংসাশী প্রাণীটি ৷ মানুষের ঘৃণা ও অবেহলায় বিলুপ্তির পথে উপকারী ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষাকারী শকুন । তবে সাম্প্রতিককালে শকুনের উপকারিতা উপলব্ধি করেছে মানুষ । তাইতো আজ বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে শকুন দিবস (৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস ) । আন্টার্টিকা ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ বাদ দিলে বিশ্বের প্রায় সর্বত্র শকুন দেখা যায় ৷ সারা বিশ্বে ৩০ এরও বেশি প্রজাতির শকুন রয়েছে ৷ এদেরকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয় , নববিশ্বের শকুন ও পুরানো বিশ্বের শকুন ৷
          খাবারের জন্য পরিবেশের ময়লা আবর্জন সাফ করে নেয় শকুন । এমন কি চামড়া ও মাংস খেয়ে কঙ্কালে পরিণত করে অবশিষ্ট দেহাবশেষ ৷ যে কারণে এদের কে পরিবেশের বন্ধু বলা হয় । শকুনই একমাত্র প্রাণী , যারা পশু হত্যা করেনা । খাবারের জন্য পশুর মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করে | ১৮০০ সাল থেকে শকুনকে উপকারী হিসাবে গণ্য করা শুরু হয় ৷ মরা পশুর শরীর থেকে জীবানু ছড়ানো রোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এরা ৷ পরিবেশবিদদের মতে বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় অত্যন্ত উপকারী এই প্রাণী । পশুর শরীরে অ্যানথ্রাক্স , জলাতঙ্ক প্রভৃতি রোগ দিন দিন বেড়েই চলেছে ৷ যা ছড়িয়ে পড়ছে মানব শরীরেও | প্রখর হজম শক্তি হওয়ায় শকুন অ্যানথ্রাক্স , জলাতঙ্ক , বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ , গবাদি পশুর শরীরের বিভিন্ন জীবানু সহজেই হজম করতে পারে ৷ শকুনের ত্যাগ করা মলে শক্তিশালী অ্যাসিড উৎপন্ন হয় ৷ প্রখর হজম শক্তিতে উৎপন্ন হওয়া অ্যাসিড জীবাণু ও ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে সক্ষম ৷ যেটা ঢেঙ্গা নামক এক প্রকার পাখির মলে থাকে ৷
          শকুন প্রখর দৃষ্টিশক্তির অধিকারী | বহু উপর থেকে এরা খাবার লক্ষ করে । উন্মুক্ত সমতল থেকে ৪ মাইল দুরের ৩ ফুট আকারের বস্তুকেউ এরা পরিস্কার দেখতে পায় । শকুন খুবই আনুগত্য হয় , পরিবারের সাথে দীর্ঘ দিন আবদ্ধ থাকে ৷ বাচ্চা জন্মানোর পর প্রায় ৮ মাস তাদের দায়িত্ব পালন করে ৷ বিশ্রামের সময়ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখে | সাধারণত ১০ থেকে ১৫ বছর গড় হিসাবে বাঁচে এরা (কালো শকুন.) | একটি পূর্ণবয়স্ক শকুন প্রায় ৭৬ থেকে ১২২ সেমি লম্বা হয় | ডানা প্রায় ৩ মিটার , লেজ ১৬ - ২১ সেমি হয় ৷ মাথা ও গলায় কোন পালক থাকে না । এরা কাউকে আক্রমন করে না ঠিকই , তবে নিজেরা আক্রান্ত হলে পায়ের এক বিশেষ অঙ্গ দিয়ে আক্রমণ করে ( যে অঙ্গ খাবার সাফ করতে ব্যবহার হয় ) | নতুন পাতা দিয়ে বাসা বেধে ডিম পারে এরা.। বছরে এক বারই ডিম পারে ৷ কোন কারনে ডিম ভেঙে গেলে বাসাও ভেঙে ফেলে এরা ৷
          বিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে শকুন রোগ ছড়াচ্ছে বলে দাবি ওঠে ৷ হাতিয়ার হিসাবে একটি মহামারিকে সামনে রাখা হয় । সেই দাবি অনুসারে বিষ প্রয়োগ ও গুলি করে হাজার হাজার শকুন মেরে ফেলা হয় । গত কয়েক দশকে ভারতেও কমেছে শকুন | প্রায় ৯৮ শতাংশ শকুন কমেছে ভারতে ৷
          শকুন কমে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল ড্রাগ ৷ ডাইক্লোফেন , যা পশুর শরীরে অতিমাত্রায় প্রয়োগের ফলে বিষক্রিয়া ঘটছে শকুনের শরীরে ৷ ফলে কিডনির অসুখে ভুগে মারা যাচ্ছে এরা ৷ খাদ্যের ঘাটতিও অন্যতম কারন । বাসা বাধারও গাছের অভাব , ফলে প্রজননে বাধা পাচ্ছে | এককথায় পরিবেশই শকুনের কাছে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে I বিশেষজ্ঞদের ধারনা , বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী প্রাণী শকুন ক্রমশ হ্রাস পেলে নষ্ট হতে পারে সামগ্রিক প্রাণীজগতের বৈচিত্র I
          ...কুন্তল পাল
          

0 comments:

Post a Comment