Thursday, January 23, 2020

বিপন্ন রাজ্যপশু বাঘরোল

       একদিন সকালে এলাকায় দেখা মেলে এক জন্তুর ৷ মৃত অবস্থাতেই পড়ে থাকতে দেখা যায় ৷ অনেকটা বাঘের মত দেখতে জন্তুটাকে নিয়ে নানা গুজব শুরু হয় ৷ পরে জানা যায় এটাই আমাদের রাজ্যপশু বাঘরোল ৷ এলাকায় কিছুদিন ধরে চুরি যাচ্ছিল হাঁস , মুরগি ৷ দিশেহারা হয়ে গ্রামের লোকজন ফাঁদও পাতেন | ফাঁদ ছিঁড়ে শিকার নিয়ে পালায় শিকারী ৷ প্রথমে সন্দেহ হয় শিয়ালের উপর ৷ কিন্তু ফাঁদের পাশে বাঘের মত পায়ের ছাপ সন্দেহ বদলে দেয় । তা হলে কি এলাকায় বাঘ ? আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এলাকাবাসী । এলাকার এক ব্যক্তির পোষা রাজহাঁস নিয়ে পালানোর চেষ্টা করে একটি জন্তু | তাড়া খেয়ে শিকার ফেলে পালিয়ে যায় । মৃত রাজহাঁসটিতে বিষ মিশিয়ে সেখানেই ফেলে রাখেন তিনি ৷ পর দিনই এলাকায় মৃত অবস্থায় ওই জন্তুটিকে পাওয়া যায় ৷ জন্তুটি ছিল বাঘরোল । কয়েক বছর আগে ঘটনাটি ঘটে উত্তর ২৪ পরগণার বাগদা থানার নৃসিংহখোলা এলাকায় ৷ এর দুদিন বাদেই এলাকার একটি ভেড়ির পাশ থেকে উদ্ধার হয়  বাঘরোল শাবক । চিতাবাঘের মত দেখতে শাবকটিকে বাড়িতে নিয়ে আসেন এক যুবক ৷ প্রাণীটি বাড়িতে রাখা বেআইনি জানাতে পেরে বনদপ্তরে খবর দেয় । জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন বন আধিকারিকরা ৷ আবারও লোকালয়ে চলে আসে শাবকটি ৷ অচেনা জন্তুটিকে কামড়ে মেরে ফেলে এলাকার কুকুর |
     
        এভাবে নানা কারনেই হারিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপশু বাঘরোল | সাধারণ বিড়ালের দ্বিগুণ আকার ও শক্তিশালী এই পশুটিকে অনেকেই মাছ ধরা বিড়াল বা মোছা বিড়াল নামে চেনেন | চলতি নাম হিসাবে বাঘডাশা , কুপায়া বাঘ প্রভৃতি নামেও পরিচিত ৷ প্রাণীবিদ্যায় Prionailurus Viverrinus নামে পরিচিত ৷ বাসস্থান Animalia . শুধুমাত্র ভারত নয় ৷ নেপাল , বাংলাদেশ , শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম , থাইল্যান্ড , বার্মা ,চিন , পাকিস্তান , ইন্দোনেশিয়া দ্বীপ এবং সুমাত্রা দ্বীপেও দেখা যায় বাঘরোল | ভারতীয় হিমালয় অঞ্চলে ১৫০০ থেকে ২১০০ মিটার উঁচুতেও দেখা মেলে রাজ্য পশু ৷ ৬৫ থেকে ৮৬ সেমি লম্বা ও ৫ থেকে ১৬ কেজি পর্যন্ত ওজন হয় ৷ লেজের আকার প্রায় ২৪ থেকে ৩৫সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয় ৷ উচ্চতা ৩০থেকে ৫৫ সেন্টিমিটার । শরীর ধূসর বর্ণের লোমে ঢাকা ৷ গায়ে লম্বালম্বি দাগ কাটা , মাঝে মাঝে কালো -বাদামি ছোপ ৷ চোখ ঈষৎ হলুদ , আলো পড়লে সবুজ আভা লক্ষ করা যায় ৷ এরা খুব ভালো সাঁতার কাটতে পারে ৷ দৌড়াতেও পটু , ঘন্টায় ৫৫ কিমি বেগে দৌড়াতে পারে ৷ এদের জীবনকাল খুবই সংক্ষিপ্ত ৷ মাত্র ১০-১৫ বছর বাঁচে এরা | মোটামুটি ৯ থেকে ১৮ মাস বয়সেই এরা সঙ্গমে লিপ্ত হয় । গর্ভধারণের প্রক্রিয়া ৬৩ থেকে ৭০ দিনে শেষ হয় | জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে এরা বাচ্চা প্রসব করে ৷ একটি মেয়ে বাঘরোল একসাথে ২-৩ টি বাচ্চা প্রসব করে | ১৬ দিন বয়সে চোখ ফোটে | দু মাস বয়স হলেই মাংস খাওয়া শুরু করে ৷ ৮-৯ মাসেই প্রাপ্তবয়স্ক ৷ ১২ থেকে ১৮ মাসে পুরোপুরি যুবক | রাত জেগে শিকার করার পর দিন এরা ঘন জঙ্গলে কাটায় । মুখে একপ্রকার আওয়াজ করে নিজেদের জানান দেয়৷
       
         এই জন্তুটিই আজ বিপন্ন ! The International Union for Conservation of Nature and Natural Resources ( IUCN ) , ২০১০ সালে এই প্রাণীটিকে বিপন্ন প্রাণী হিসাবে ঘোষণা করেছে । বন্যপ্রাণী আইন ১৯৭২ অনুসারেও বাঘরোল লুপ্তপ্রায় প্রাণী ৷ এদেরকে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন ৷ পরিবেশের সামঞ্জস্য বজায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে বাঘরোল ৷ সরকারি ভাবে কড়া পদক্ষেপ না নেওয়ায় দিন দিন কমছে বাঘরোলের সংখ্যা | বর্তমানে সারা দেশে মাত্র ৩ হাজার বাঘরোল রয়েছে ৷ বেশির ভাগই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে I যার সিংহভাগ হাওড়া জেলায় ৷ একসময় সুন্দরবনের জলাভূমি এলাকা , পূর্ব কলকাতার বিস্তৃর্ণ জলাভূমি ও হাওড়ায় প্রচুর পরিমানে বাঘরোল দেখা যেত । সাম্প্রতিক কালে সুন্দরবনের বেশির ভাগ এলাকা বাঘের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে , বাকি জায়গায় গজিয়ে উঠেছে বাসস্থান | কলকাতা হাওড়াতেও জলাভূমি বুজিয়ে বহুতল গড়ে উঠেছে,ফলে ওদের বাসস্থান ও আশ্রয়ের অভাব দেখা দিয়েছে ৷ এছাড়াও চোরাশিকারির দ্বারা আক্রান্ত হয়েও কমছে সংখ্যাটা ৷ মাছ এদের প্রিয় খাদ্য হলেও প্রচুর পরিমানে ইঁদুর খেয়ে এরা চাষে উপকার করে ৷ এছাড়াও নানা প্রকার সরীসৃপ, পাখি প্রভৃতি এদের খাদ্য |
       
       বাঘরোল কে বাঘের সমগোত্রীয় তুলনা করা হয় ৷ যদিও একটি বাঘকে বাঁচাতে সরকারী ভাবে যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় তার বিন্দু মাত্র উদ্যোগ নেওয়া হয় না বাঘরোলকে বাঁচাতে | আমাদেরকে উদ্যোগী হতে হবে৷ রাজ্য পশুকে বাঁচাতে পারলে এক দিকে যেমন চাষবাসে উপকার হবে , তেমনই রক্ষা হবে জীব বৈচিত্র । এরা বাঁচলেই রক্ষা হবে খাদ্য-খাদক শৃঙ্খল , বাঁচব আমরা ৷
                          ........শেষ
      কুন্তল পাল

0 comments:

Post a Comment