" সবার চেয়ে খেতে ভালো পাউরুটি আর ঝোলা গুড় " ....
লাইনটা মনে পড়লেই মনে পড়ে শীত কালের কথা ৷ শীত মানেই খেজুর রস নলেন গুড় , পিঠে -পায়েস-পুলি | শীত মানেই জয়নগরের মোয়া | শীতের সকালে কাঁপতে কাঁপতে এক গ্লাস মিষ্টি খেজুর রসের তুলনা হয় না ৷ কাঠাল পাতায় গরম খেজুর গুড় মনে করিয়ে দেয় হারানো শীতের শৈশব ।
যারা খেজুর রস ও নলেন গুড় তৈরি করে তাদের শিউলি বলে | হিন্দু সম্প্রদায় ভুক্ত প্রাচীন এক জাতি | প্রাচীনকাল থেকেই খেজুর গাছ থেকে রস বার করার কাজ করে আসছে ওরা | সেই রস থেকে গুড় ও তৈরি করে ৷ তবে তাদের আজ আর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে | এসেছে অন্যান্য জাতির মানুষ | বাধা পেয়েছে তাদের সাধের পেশা | এখন আর এই পেশায় কেউ আসে না ৷ যাকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকবে এই পেশা সেই খেজুর গাছই আজ আর দেখা যায় না ৷ সারি সারি মাঠের খেজুর গাছ পুড়ছে ভাটায় | অবশিষ্ট দুএকটি গাছ আঁকড়ে পেশাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার শিউলিরা ৷ আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হয় গাছ পরিস্কার করার কাজ I প্রথমে গাছ ঝোড়া | এরপর গাছে চাছ দেওয়া হয় | অগ্রহায়ন মাসে গাছে বসে কন্ঠনালি | সেই নালি দিয়েই বের হয় মিষ্টি রস | এক একটি করে গাছের শুকনো পাতা কেটে ফেলতে হবে সবার আগে ৷ বালিকাচায় ধার তুলে তুলে জুৎসই করে নিতে হবে ছ্যান ৷ সেই ধারালো ছ্যান দিয়ে গাছের আগা চেঁছে চেঁছে কন্ঠনালি বসাতে হবে ৷নলের মুখে বসাতে হবে

ভাঁড় , সেই ভাঁড়ে সারা রাত টুপ টুপ করে জমবে রস ৷ খেজুর গাছেরও লিঙ্গভেদ রয়েছে৷ মেয়ে গাছে রস বেশি হয় | পুরুষ গাছের তুলনায় মিষ্টিও হয় বেশি | কত বছর ধরে একটি গাছ রস দিচ্ছে তা গাছের গায়ে গাট গুনে বলে দেওয়া যায় ৷ কিছু কিছু গাছ কে রেস্ট বা জিরোতে দেওয়া হ্য় | মাঝে মাঝে কাটা হ্য় | সেকারণে সেইসব গাছের রসকে জিরেন রস বলে৷ সাধারণ রসের তুলনায় জিরেন রস মিষ্টি বেশি হয় ৷ রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করাও কষ্টসাধ্য কাজ | গুড় তৈরি হতে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে | গুড় সম্পূর্ণ হওয়ার ২০ মিনিট আগে তৈরি হয় নলেন গুড় ৷ এরপর ঝোলাগুড় , দানাগুড় , জিরেন গুড় , চিটেগুড় প্রভৃতি | গুড় তৈরি হয়েছে কিনা ,তা কড়াইয়ে 'বিচ মেরে ' বোঝা যায় ৷ নারকেল মালা ও বাঁশ দিয়ে তৈরি হয় গুড় তোলার পাত্র I নলেন গুড় ও পাটালির চাহিদা সবচেয়ে বেশি | রস জ্বালিয়ে কলাপাতার উপর জমানো হয় পাটালি ৷ এককাট , দোকাট , তেকাট রস হয় গাছ থেকে ৷ অনেকে আবার চৌকাট রস বের করে ৷এককাট রস দিয়ে তৈরি হয় নলেন গুড় ৷ দোকাট বা তে কাট রস দিয়ে তৈরি হয় ঝোলাগুড় ৷ এই গুড়ের স্বাদ কিছুটা টক হয় ৷ রস গুড়ে পরিনত হলেই স্বার্থক হবে "খেজমৎ মেহনৎ " |



খেজুর রস থেকে তৈরি নলেন গুড় বাংলার মানিচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে প্রাচীনকালেই । নলেন গুড়ের সন্দেশ বা রসোগোল্লা গ্রাম থেকে শহর এমন কি বিদেশেও সুখ্যাতি লাভ করেছে ৷ নলেন গুড়ের পায়েসের তুলনায় হয় না | বাঙালির অতি প্রিয় জয়নগরের মোয়ার প্রধান উপকরণই নলেন গুড় । খেজুর রস কিছুটা জ্বালানোর পর লালচে হলে তাকে তাঁতরস বলে ৷ তাঁতরস দিয়ে মুড়ি খাওয়ার জন্য বাঙালি আজও অপেক্ষা করে থাকে ৷দল বেঁধে রস চুরি আজও গ্রামবাংলার কিশোর যুবকদের কাছে আনন্দের ৷ ভয়ে ভয়ে গাছে উঠে পাটকাঠির নলে ভাঁড়ের রস খাওয়ার মধ্যেই যেন আনন্দ খুঁজে পায় ওরা | তবে এটাকে চুরি বলতে নারাজ অনেকই । গাছের মালিকও এসবের মধ্যে নিজের শৈশবকে খোঁজার চেষ্টা করে৷ নরেন্দ্রনাথ মিত্রের লেখা 'রস' গল্পে বর্ণিত হয়েছে খেজুর রসের কাহিনী | জোয়ান মোতালেফ ও রাজেক মৃধার বিধবা স্ত্রী মাজু খাতুনের প্রেম কাহিনী | সিনেমাও তৈরি হয়েছে ৷ 'সওদাগর' সিনেমায় অমিতাভ বচ্চনের অভিনয় আজও দর্শকের মনকে টানে ৷
এত কিছুর মধ্যেও গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের পেশাকে বাঁচিয়ে রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে শিউলিরা | এক দিকে নতুন করে এই পেশায় না আসা , অন্যদিকে খেজুর গাছের অভাব । দুয়ে মিলে হারিয়ে যেতে বসেছে এই পেশা | গ্রাম বাংলার শিউলি দের গলায় হতাশার সুর " নতুন করে কোন পুলাপান আর আসছে না । নিজের পুলাও আর একাজ করতে চাইছে না । এখন আর কেউ খেজুর গাছেই উঠতে পারে না , পেশা বাচবে কেমনে ? " অনেকেই মাঠের খেজুর গাছ কেটে ভাটায় জ্বালানি হিসাবে বিক্রি করে দিচ্ছে মোটা টাকার লোভে । ফলে কমছে গাছ ৷
এক সময় বাংলাদেশ থেকেও শীতের মরশুমে অনেক শিউলি আসত এই বাংলায় | আজ আর আসে না ! কমেছে গাছ , কমেছে শিউলি ৷ নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, উত্তর ২৪ পরগণা , দক্ষিণ ২৪ পরগণা , হাওড়া প্রভৃতি জেলায় আজও শিউলিদের দেখা যায় ঠিকই , তবে তাদের চোখে মুখে করুন আর্তি ... ' যেন না হারায় এই পেশা '| গাছির আদর গাছই বোঝে ৷ গাছের মালিকরা বুঝলে অস্তিত্ব বাঁচানোর লড়াইয়ে লড়তে হত না গ্রাম বাংলার শিউলিদের | ..... শেষ
.... কুন্তল পাল
.... কুন্তল পাল
0 comments:
Post a Comment