আস্তাবল শূন্য হয়েছে অনেক আগেই ৷ বর্তমানে আস্তাবলের কোন চিহ্নই আজ আর নেই ৷ অতীতের সেসব গল্প শুনে আজ কেউই বিশ্বাস করবে না , এখানেই ছিল বিরাট আস্তাবল | ছিল নহবত খানা , হেপাজতখানা, শিশু মহল , দরবার মহল , রাজমহল আরও কত প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন ৷ সে সবই আজ হারিয়ে গিয়েছে ৷ অতীত দিনের গৌরব হারিয়ে কঙ্কালসার ধ্বংসস্তুপের মত দাড়িঁয়ে আছে মঙ্গলগঞ্জের নীলকুঠী | কিছুদিন পর হয়ত শেষ স্মৃতি টুকুও ধুলোয় মিশে যাবে !
উত্তর ২৪ পরগণার সীমান্তবর্তী বাগদা থানা | এই থানার অন্তর্গত মঙ্গলগঞ্জ একসময় ছিল দর্শনীয় স্থান ৷ ইছামতীর তীরে বিরাট এলাকা জুড়ে দাঁড়িয়ে নীলকুঠী । স্থানীয়রা অবশ্য 'সদন' নামেই জেনে এসেছে ৷ ইছামতীর একপাশে নীলকুঠী , অন্যপাশে বিভূতিভূষণ অভয়ারণ্য ৷ যেখানে রয়েছে রাজ্যের দ্বিতীয় ডিয়ার পার্ক |
বিশাল এলাকা জুড়ে নীলচাষকে কেন্দ্র করে একসময় কর্মব্যস্ত ছিল নীলকুঠী । কালের নিয়মে ব্যস্ততা আজ আর নেই ৷ বিরাট কুঠীর সামান্য অংশ আজ বর্তমান | কয়েদ ঘরের তালা ভেঙে গিয়েছে অনেক আগেই । ঘরটিও আজ আর নেই ৷ নেই কাছাড়ি বাড়িটাও ৷ এখন শুধুই আগাছা ! অথচ এই কুঠীকে ঘিরেই ছিল কৃষ্ণচুড়া , রাধাচুড়া , বকুল, পলাশ , শিমূল আরও কত ফুল ফলের গাছ । এসব দেখতে দূর দুরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসত । আজ আর কেউ আসেনা ৷ বিষাক্ত সাপ আর বন্যজন্তুদের আস্তানা মঙ্গলগঞ্জে আজ বিষাদের সুর ৷
অতীতদিনের দুএক জন ছাড়া মঙ্গলগঞ্জের ইতিহাস সম্পর্কে কারও তেমন ধারণা নেই | মঙ্গলগঞ্জের ইতিহাস জানতে বা জানাতে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি সরকার । দু-একটি বই থেকে কিছুটা জানা গেলেও নীলকুঠীর পুরো ইতিহাস অনেকেরই অজানা ৷ প্রায় ২০০ বছর আগে ভিত্তি পত্তন হয়েছিল নীলকুঠীর ৷ ৬৫ বিঘা জমিকে ঘিরে বিশাল নীলচাষ শুরু হয় । গোবরডাঙ্গার খাটুরা অঞ্চলের ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন মঙ্গলচন্দ্র আঁশ । অবিভক্ত বাংলায় ব্যবসায় খ্যাতি অর্জন করেছিলেন । বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহ থেকে সমগ্র যশোর জেলায় তাঁর ব্যবসা বিস্তার ছিল ৷ মঙ্গলচন্দ্রের পুত্র লক্ষণ চন্দ্র আঁশ | বারশালের বিধবাকে দ্বিতীয় বার বিয়ে করায় বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হ্য় লক্ষণ চন্দ্রের। সম্পর্ক ছিন্ন করার সময় ছেলেকে প্রচুর সম্পত্তি দেন মঙ্গলচন্দ্র | সেই সময় মঙ্গলগঞ্জের জমিদার ছিলেন কোন এক ঘোষ বাবু | ব্যবসায় সুবিধা করতে না পারায় নগদ অর্থের বিনিময়ে লক্ষণচন্দ্রকে জমিদারি হস্তান্তর করেন তিনি ৷ বাবার নাম অনুসারে এখানকার নাম রাখেন মঙ্গলগঞ্জ । ইছামতীর তীরে বিশাল জমি দেখে ভালো লেগে যায় লক্ষণ চন্দ্রের | সাহেব কোপানির সাথে যোগাযোগ করে পত্তন করলেন নীলকুঠী | সেখানকার রাজা হলেন লক্ষণচন্দ্র আঁশ । মাত্র ১০ বছর রাজত্ব করে মারা যান রাজা | একে একে মারা যান ৩ মেয়ে ও ২ ছেলে ৷ শেষ পর্যন্ত ছোট মেয়েই বেঁচে ছিলেন | এলাকায় পিসিমা নামে পরিচিত ছিলেন তিনি ৷
এখানেই গড়ে উঠেছিল নীলের গুদামঘর , নীলপচানের চৌবাচ্চা ৷ যদিও এখন তার চিহ্নমাত্র নেই৷১৯০৩ সালে গুদামঘরে প্রাইমারি স্কুলের প্রতিষ্ঠা হয় ৷ পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালে একটি ঘরে পোস্ট অফিসের অনুমোদন দেন পিসীমা সাবিত্রী আঁশ | তাঁর সাথে পরিচয় ছিল তৎকালীন কালিম্পং এর এম পি মৈত্রী বোসের ৷ তাঁর সাথে আলোচনা করে বিরাট এই এলাকা ভারত সরকার পরিচালিত 'শিশুরক্ষা সমিতি'কে দান করেন সাবিত্রী আঁশ । মোটামুটি ষাটের দশকে সম্পত্তি দান করে এলাকা ছেড়ে চলে যান তিনি ৷ এরপর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনাথ ছেলে-মেয়েরা এখানে আসতে শুরু করে । তবে এখন আর নেই তারা। ওই সমিতির বিরুদ্ধেও অভিযোগ ওঠে ৷ বিদেশ থেকে অনুদান সত্ত্বেও অভুক্ত থাকতে হত শিশুদের.৷
জলপথে যোগাযোগের সুবিধা থাকায় অল্পদিনেই বিস্তার লাভ করে মঙ্গলগঞ্জের নীল চাষ । জলপথে উৎপাদিত নীল পাড়ি দিত বিভিন্ন দেশে । এলাকার সমস্থ চাষীকেই বাধ্য করা হত নীল চাষে । অবাধ্য চাষীদের উপর চলত নির্মম অত্যাচার | দেশ স্বাধীন হলে চলে যায় ইংরেজরা ৷ সদাব্যস্ত ও চোখ রাঙানির হাত থেকে রক্ষা পেয়ে শান্ত হয় নীলকুঠী । প্রাইমারি স্কুল ও কচিকাচাদের কোলাহলে নবজীবন ফিরে পায় মঙ্গলগঞ্জ ৷ ফুলে ফলে ভরা মঙ্গলগঞ্জে তখন শুধুই পাখির কলোরব | কালে কালে তা শেষ হতে থাকে ৷ এখন আর একটিও গাছ নেই স্বাক্ষ্য বহন করার জন্য I দু-এক টি যা আছে তা বর্তমান প্রজন্মের ৷ বিরাট শালবাগান চুরি হয়ে গিয়েছে ৷ দখলদারিতে কমে এসেছে বিরাট এলাকা। চুরি হয়েছে জমিদারির শ্বেত পাথরের টেবিল , রূপোর ফুলদানি , ঝাড়লণ্ঠন আরও কত কিছু |
মঙ্গলগঞ্জের বিরাট এই এলাকাকে কেন্দ্র করে এখানেই গড়ে উঠতে পারত পর্যটন কেন্দ্র ৷ পড়ে থাকা বিরাট খেলার মাঠকে কেন্দ্র করে তৈরি হতে পারত স্পোটর্স কমপ্লেক্স ৷ সরকার উদ্যোগী হলে এখনও এখানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব ৷ পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠলেই মানুষজন আসবেন নীলকর সাহেবদের স্বাক্ষ্য বহনকারী মঙ্গলগঞ্জে ৷ আবারও কোলাহলে মেতে উঠবে নীলকুঠী , থাকবে না শুধুই ইংরেজদের চোখরাঙানি ৷
....শেষ।
.... কুন্তল পাল
0 comments:
Post a Comment