কর্মকার | চলতি ভাষায় কামার৷ এদের কর্মস্থলই কামারশালা ৷ শক্ত লোহা পিটিয়ে দা , কোদাল , কুড়ুল প্রভৃতি তৈরি হয় কামারশালায় । অতীত দিনের সেই কামারশালা আজ আর দেখা যায় না বললেই চলে ৷ দু-একটি আজও অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছে । নতুন করে এই পেশায় আজ আর কেউ আসতে চান না |
অতীতের কামারশালা বলতে দু চালা বা একচালা ভাঙাচোরা একটি ঘর , দুচারটে যন্ত্রপাতি , একটু কয়লা ও আগুন । চারপাশে ভেসে বেড়াত কয়লা পোড়ার গন্ধ ৷ কানে আসত অদ্ভুত এক শব্দ , যা কামারদের প্রধান যন্ত্র 'হাপর ' থেকে আসত ৷ এছাড়াও থাকত 'নিন', হাতুরি , চিমটা বা শাঁড়াশি, হাম্বুর প্রভৃতি | একপাশে ছোট্ট একটা চারিতে থাকত জল ৷ এই নিয়েই কামারদের সংসার ৷
প্রধান যন্ত্র হাপর দেখতে অনেকটা লম্বালম্বি ভাবে চেরা প্যারাস্যুট বা চ্যাপটা বেলুনের মত ৷ ওই একই আকারের তিনটি কাঠের পাটাতনের প্রতিটির সাথে প্রতিটি চামড়া দিয়ে যুক্ত ৷ মাঝখানে ও শেষের কাঠে একটি করে চার কোণা দরজা থাকে ৷ শেষ প্রান্তে একটি সরু লোহার নল বের হয়ে উনুনের সঙ্গে যুক্ত থাকে ৷ নলটি একটি কাঠের মাধ্যমে উনুনে যুক্ত হয় , যার মাঝ বরাবর মোটা ছিদ্র থাকে I সেই ছিদ্র দিয়ে উনুনে বাতাস যায় ৷ হাপারের সাথে তিন বেড়ের শিকল লাগানো থাকে ৷ দুপাশে দুটি বাঁশের খুঁটি ও একটি আঁড়া , আঁড়ার সাথে লম্বালম্বি ভাবে একটি বাঁশের লাঠি | পিছনের দিকটি হাপরের সাথে শিকল দ্বারা যুক্ত ৷ লাঠির সামনের দিকে যুক্ত শিকল টেনে হাওয়া করা হয় । যত বেশি টানা হবে তত বেশি হাওয়া হবে | দু পাশে দুটি বাঁশের খুঁটি ও একটি আঁড়া, এটাই তিন বেড়ে ৷ হাপর তৈরিতে মূলত গরুর চামড়া ব্যবহার করা হয় । নিন অনেকটা ইংরাজি 'টি' অক্ষরের মত দেখতে শক্ত লোহার টুকরো , যেটা মাটির মধ্যে পোঁতা থাকে । এর উপর গরম লোহা রেখে পেটানো হয় । রেলের পাটি কেটে তৈরি করা হয় পাটা , পাটার উপর গরম লোহা রেখে কাটা হয় । কামারশালার একপাশে মাটির মধ্যে অর্ধেক পোঁতা অবস্থায় রাখা থাকে একটি মাটির পাত্র , যার মধ্যে জল থাকে ৷ লোহা পিটিয়ে জিনিস তৈরি হয়ে গেলে গরম জিনিসটিকে জলে ডুবিয়ে রাখা হয় I একে চারি বলে । দা , কোদাল , কুড়ুল প্রভৃতি জিনিস তৈরিতে আলাদা আলাদা যন্ত্রের প্রয়োজন | সবকিছুই তৈরির পর উঁকো দিয়ে ঘষে ধারালো করা হয় ৷ একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ কামার উনুনের কয়লার রং ও লোহা পোড়ার গন্ধে বলে দিতে পারেন লোহা পোড়া হয়েছে কিনা ।
একসময় চাষীদের কাছে কামারশালা খুবই প্রয়োজনীয় ছিল । নাঙলের ফাল পোড়াবার জন্য কামারশালায় ভিড় লেগেই থাকত I বর্তমানে মানব চালিত গরুটানা নাঙলের ব্যবহার কমেছে ৷ চাষীদের কাছেও কদর কমেছে কামারদের | নতুন লাট্টু কিনে আল পরানোর কামারদের কাছে ছুটে যেত যুবকরা । বর্তমানে লাট্টু খেলা দেখা যায় না বললেই চলে | ফলে যত দিন এগোচ্ছে তত কদর কমছে কামারদের । এক দিন হয়ত হারিয়ে যাবে এই পেশা ! হারিয়ে যাবেন কামাররা !
.......কুন্তল পাল
0 comments:
Post a Comment