এক'টা সময় ছিল মানব জীবন কিছু জিনিস ছাড়া চলত না ৷ যুগের পরিবর্তনের সাথে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক কিছুই । আধুনিক যন্ত্রচালিত মানব জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে বিদায় নিয়েছে তালপাতার পাখা । সেলুলয়েডের যুগে প্লাস্টিকের দাপটে তালপাতা আজ ব্রাত্য | কোলকাতার মত মহানগর নয় ! মফ্সলের শহর ঘুরেও আজ আর তালপাতার পাখা মেলানো যায় না । গাঁ গজ্ঞে হয় তো বা দুএকটা আজও স্বাক্ষ্য বহন করে চলেছে ৷
ছোট ছোট নানা মাপের গোল গোল করে কাটা তালপাতার মাথা গুলি কঞ্চির চোছ দিয়ে মুড়ে দেওয়া হত ৷ যার ফলে সহজেই বাতাস কাটতে পারে । বাঁশের ফালি চিরে হাতাল লাগানো থাকে ৷ এখনও মুদির দোকানে ঝাটার সাথে বিক্রি হতে দেখা যায় । তবে তা যে কোন সময় হারিয়ে যাবার আশঙ্কায় দিন গুনছেন সাধারণ মানুষ । যদিও এ পাখার সাথে আসল তালপাতার পাখার পার্থক্য অনেক ৷ তালপাতার যে পাখা আমাদের চোখে ভাসে তার ধাঁচই আলাদা ৷ তালগাছের পাতার উপর নির্ভর করে পাখার আকার ৷ একটি পাতা দিয়ে সর্বোচ্চ দুটি পাখা তৈরি হয় ৷ পাতার ডাটি সমেত মাঝখান দিয়ে চিরে নেওয়া হয় ৷ সুবিধা মত ডাটি সাইজ করে তৈরি হয় হাতল । হাতল মসৃণ করে তেল মাখানো হয় ধরবার সুবিধার্থে ৷ পাতার শিরার মাপ করে গোল করে কাটা হয় , যাতে হাতলের সাথে যুক্ত থাকে সেদিকেও নজর রাখা হয় ৷পাতার ধার বরাবর বাঁশের সরু চোছ কাঠির মত আকারে সুতো দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয় , যাতে লখলখে না থাকে ৷ সহজেই যাতে নখের আঁচড়ে চিরে না যায় সেদিকেও নজর রাখা হয় | তবে , সবার আগে গাছ থেকে কাটার পর পাতাটিকে জলে ভিজিয়ে রাখা হয় ৷ না হলে শুকিয়ে ছোট হয়ে যাবার ভয় থাকে ৷ পাখাকে আরও সুন্দর করে তোলার জন্য তালপাতা চিরে সরু করে বরফি আকারে ধার বরাবর বেঁধে দেওয়া হয় ৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে আলতা দিয়ে সেই বরফি গুলি রং করে দেওয়া হত | মা -ঠাকুমারা রঙিন কাপড় বা কাপড়ের পাড় কুচি দিয়ে সেলাই করে পাখার ধার বরাবর বসিয়ে দিতেন ৷ হাতলে রঙিন সুতো জড়িয়ে দিতন যাতে প্রতিদিন ব্যবহারের ফলে তেল চিটে না হয়ে যায় ৷ অপরূপ এই পাখার শীতল বাতাসে জুড়িয়ে যেত প্রাণ ৷ শরীরের সব ক্লান্তি মুছে দিত পাখার হাওয়া ৷
গ্রীষ্মের সময় বাড়িতে কেউ এলে বাড়ির ছোট দেরও দেখতাম তাঁর হাতে একটি পাখা এগিয়ে দিতে ৷ সাথে এক গ্লাস ঠান্ডা জল । ঠাকুমার পাশে শুয়ে অচিনপুরের গল্প শোনার অভিজ্ঞতা প্রায় সকলেরই আছে | গল্প বলতে বলতে ঠাকুমা হাতপাখা নেড়ে হাওয়া করতেন, কখন যেন ঘুমিয়ে পড়তাম ৷ ঘুমের ঘোরে পাখা নাড়ার শব্দ অপরূপ লাগত ৷ ঠাকুমাও ঘুমিয়ে পড়তেন ৷ ঘুমের ঘোরে গায়ে পাখার আঘাত লাগলে অদ্ভুত এক নিয়ম মেনে ক্ষমা চেয়ে নিতেন , পাখাটা মাটিতে ঠুকে নিতেন ৷ এ যেন মাটিতে মাথা ঠোকা ৷ শুধু শোবার ঘরে নয় , উনুনে বাতাস দেবার জন্য উনুনের পাশেও থাকত কালি ঝুলি মাখা একটা পাখা ৷ উনুনে হাওয়া দেওয়ার সময় পাখার শব্দ অদ্ভুত লাগত I জামাইষষ্ঠীর দিনে তালপাখা জলে ভিজিয়ে জামাইদের শুভ কামনায় শাশুড়ি বলতেন , ' ষাট্ ষাট্ , ষষ্ঠীর ষাট্ ' ৷ এ ছবি আজও দেখা যায় , তবে তা সিনেমায় ৷
পাখা শুধু বাতাস দেওয়ার জন্যই নয় , মাছ চুরি করে পালানোর সময় বিড়াল কেই পাখার বাড়ি হজম করতে হত । মায়ের ঘুমের সুযোগে আচঁলের পয়সা 'চুরি' করে পাখার বাড়ি খেতে হয়েছে অনেক কেই ৷ তবে এসবের মধ্যে আনন্দও ছিল ৷ যা আজকের ছেলে-মেয়েদের কাছে গল্প কথা । এসব থেকে তারা বঞ্চিত হলেও আধুনিক এসি মেশিন তাদের সেই ব্যথা অনেকটাই মুছে দিয়েছে ৷ ইলেকট্রিক ফ্যান ও এসির বাতাসে মুছে গিয়েছে তালপাতার পাখার নাম ৷
....কুন্তল পাল
0 comments:
Post a Comment