Monday, September 14, 2020

স্বাধীনতার ৭২ বছর পার, তেরোঘরে আজও উড়ে না কোনো জাতীয় পতাকা

         




        স্বাধীনতার এতদিন পরও তেরোঘরে ওড়েনি কোনো জাতীও পতাকা। আজও গ্রামে নেই কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নেই পানীয় জলের বন্দোবস্ত।নেই স্কুল, নেই নিরাপত্তা, নেই স্বীকৃতি, নেই স্বাধীনতা, নেই ......। এ যেন নেই রাজ্য। উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁর ছিটমহল 'তেরোঘর' । পাখির কলরবের বদলে এখনে মানুষের ঘুম ভাঙে জওয়ানদের বুটের শব্দে।বনগাঁ থেকে মাত্র ৮ কিমি দূরে 'তেরোঘর'। স্রোতহারা একটি খালের পাশে ছোট্ট গ্রাম। জলপথই একমাত্র ভরসা এখানে। নিরাপত্তা বলতে একমাত্র ভগবান। গ্রামের তিন দিক বাংলাদেশ। নেই কোন কাঁটাতারের বেড়া।গ্রামের দুপাশে বাংলাদেশ সেনাদের ছউনি। গ্রামের পাশের গ্রাম কালিয়ানি গ্রামে রয়েছে ভারতীয় সেনাদের ছউনি। জওয়ানদের মর্জির উপর নির্ভর করেই চলতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের । 



পেট্রাপোল সীমান্তের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে একটি খাল। ইছামতি নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে বয়ে গিয়েছে বাংলাদেশের ভিতর। মিশেছে কপতাক্ষ নদের সাথে । বিভিন্ন জায়গাই নানা নামে পরিচিত খালটি। কথিত আছে এই খাল দিয়ে  যাতায়াত করত বড় বড় বজরা । খালটির দ্বীপে দোঘর বা মেদের ট্যাঁক গ্রাম। গ্রামের ওপারে তেরোঘর গ্রাম। দু ঘর পরিবার প্রথম বসবাস শুরু করেছিল বলে গ্রামটির নাম তেরোঘর। বর্তমানে গ্রামে ৫/৬ টি পরিবার বসবাস করে । অপরদিকে ১৩ টি পরিবার প্রথম বসবাস শুরু করলেও যত সময় গড়িয়েছে ততই কমেছে তেরোঘর এর পরিবারের সংখ্যা। সেখানে এখন মাত্র ৬/৭ টি পরিবার বসবাস করে। গ্রামে পৌঁছায় না রাজনৈতিক তরজা। ওরা রাজনীতি বোঝে না। ওরা মৌলিক অধিকার চায়। তবে ,সম্প্রতি দেশের দুএকটি নির্বাচনের  আগে নেতাদের যাতায়াত ওদের মনে কিছুটা ধারনা গড়ে তুলেছে। যদিও প্রতিশ্রুতি ছাড়া কিছুই জোটেনি। দেশের স্বাধীনতার ৩ দিন পর স্বাধীন হয়েছিল বনগাঁ । তেরোঘর এর বাসিন্দারা এরও এক মাস পর সেনাবাহিনীর সীমান্ত নির্ধারণ পিলার দেখে বুঝেছিল তারা ভারাতবাসী।গ্রামে সকলেই জেলে সম্প্রদায়ের। মাছ ধরে জিবিকা নির্বাহ করে ওরা। ছোট্ট খালটি বাঁচিয়ে রেখেছে ওদের। আবার বর্ষাকালে এই খালের জলেই দুকুল ভাসে ওদের।স্বাধীনতা শব্দটার সাথে ওদের যে কোন সম্পর্ক নেই তা ওদের কথাতেই বোঝা যায় । ওরা জানে দুর্গম পথ পেরিয়ে বাজারে মাছ বিক্রি করেই ওদের খেতে হবে। নিজ গৃহে বাস করেও ওরা যেন পরবাসী। নিজের দেশে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা যেতে ওদের অনুমতির প্রয়োজন হয়। অথচ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গাই ওরা সহজেই যেতে পারে । আজও বাড়ির মেয়েকে অন্যের বাড়ি রেখে বিয়ে দিতে হয়। বাড়িতে অতিথি এলে জওয়ানদের অনুমতি লাগে। এত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বাপ ঠাকুরদার রেখে যাওয়া ভিটে মাটি আঁকড়ে পরে আছে ওরা। একটাই আশা যদি কখনও জোটে স্বীকৃতি । স্বাধীন দেশের নাগরিক ওরা। স্বাধীনতার কথা শুনলেই অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে একে অপরের দিকে। ভারতবাসীর কাছে এর চেয়ে লজ্জা আর কি হতে পারে ?




বদলেছে যুগ, বদলেছে সমাজ। বদলেছে ওরাও। অতীতের তেরোঘরের সাথে পার্থক্য গড়েছে বর্তমান । অতীতে তেরোঘরের বাসিন্দারা সহজেই মিশতে পারত পূর্ববঙ্গের সাথে।ক্রমশ খারাপ পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের নাগারিকদের সাথে সম্পর্ক । সাবলীলভাবে প্রকাশ্যে আর ওদের সাথে মিশতে পারে না। কূটনৈতিক টানাপড়েনে জওয়ানদের চোখরাঙ্গানি ওদেরকে ভীত করে তুলেছে। আজ আর ঢেউ উঠেনা মরা খালে । বহু বাঁধা পেরিয়ে আজ স্কুলে যায় গ্রামের ছেলে-মেয়েরা। সেখানেই জানতে পারে স্বাধীনতার কথা। বাড়িতে পড়তে বসে দাদুর কাছে ছোট্ট মেয়েটি জানতে চাই , স্বাধীনতার মানে! ভুরু কুঁচকান আশি পেরানো বৃদ্ধ। 


স্বাধীনতা দিবসে সারা দেশে ওড়ে জাতীয় পতাকা। সেদিনও তেরোঘরে ওড়ে না জাতীয় পতাকা। দূরে জাতীয় পতাকা দেখে ছুটে যান বৃদ্ধ। চোখে মুখে হাসি। বেশিক্ষন স্থায়ী হয় না হাসি। জওয়ানদের ইশারা তাঁকে ফিরিয়ে দেয় ছোট্ট টালির ঘরে।


---- কুন্তল পাল   

লজেন্স ! হাসায়- কাঁদায়

        


উপরে শক্ত আবরণ যুক্ত রং বে রং এর ছোট্ট মিষ্টি সুস্বাদু  একপ্রকার খাবারই লজেন্স। বাচ্চা-বুড়ো সকলের কাছেই এর সমান গ্রহনযোগ্যতা। ছোট্ট এই খাবারটির স্বাদ নেন নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।  বাচ্চাদের বায়না ভোলানো থেকে বয়স্কদের অবসর সময় কাটানোয় লজেন্সের ভূমিকা অপরিসীম। আমাদের সমাজে ক্যাণ্ডি , ট্রফি নানা নামে পরিচিত লজেন্স। 

লজেন্স শক্ত এক প্রকার মিষ্টি। যা চুষে বা চিবিয়ে খেলে ভিতরে নরম। যেটা চিনি এবং মাখন একসাথে সেদ্ধ করে তৈরি হয়। বিভিন্ন রকম  স্বাদের জন্য এর সাথে অন্যান্য রং বা গন্ধজাত দ্রব্য মিশ্রণ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে কাজু বাদাম বা নারকেলও মিশ্রণ করা হয় আরও সুস্বাদের জন্য। লজেন্স সবচেয়ে জনপ্রিয় যাদের কাছে সেই শিশুদের কথা মাথায় রেখেই দিন দিন বদলাচ্ছে লজেন্সের স্বাদ-বর্ণ-গন্ধ। আরও আকর্ষনীয় করার জন্য বদলাচ্ছে আকারও। বাবা মায়ের কাছে বায়না ভোলানোর সহজ ও আদি উপায় এই লজেন্স। যা মূহুর্তের মধ্যে বাচ্চার কান্না থামিয়ে দেয়। মাছ লজেন্স, কাঠি লজেন্স, টিকটিকি লজেন্স একসময় বাচ্চাদের কাছে খুবই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। যদিও অতীত দিনের সেই সব লজেন্স আজ আর দেখা যায় না। এসবের জায়গায় এসেছে নামিদামী কোম্পানির ক্যাটবেরী। 


স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস, বড়দিন প্রভৃতি দিনে স্কুল বা ক্লাবের থেকে পাওয়া একটি লজেন্স আজও শিশু মনে আনন্দ দেয়। ট্রেনে বসে অবসর সময় কাটাতে লজেন্সের জুরি মেলা ভার। ঠাণ্ডা লেগে গলার অস্বস্থি কাটাতেও লজেন্স খুবই উপকারি। লজেন্স যেমন আনন্দ দেয় , খুশিতে রাখে, একাকিত্ব ভোলায় , আবার এই লজেন্সই মানুষকে কাঁদায়। সারা জীবনের জন্য চোখে জল এনে দেয় এই লজেন্স।এই লজেন্সই জীবনে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। খবরের কাগজ খুললেই চোখে পড়ে ‘ লজেন্সের লোভ দেখিয়ে জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রীকে যৌন হেনস্থা’। কিংবা ‘লজেন্সের লোভ দেখিয়ে নাবালিকাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষন করে খুন করল প্রতিবেশী যুবক’। লজেন্স সারা জীবন এই নির্যাতিতা মানুষ ও তাদের পরিবারকে কাঁদায়। লজেন্সের নাম শুনলেই আঁতকে ওঠেন নির্যাতিতার মা। ট্রেনে সহকর্মীর কাছ থেকে লজেন্স খেয়ে বেঁহুশ হয়ে অনেকের সর্বস্ব খোয়া গিয়েছে। লজেন্স তাদের জীবনেও অভিশাপ।


---- কুন্তল পাল 

Friday, September 11, 2020

শিল কাটাবে শিল... ,শিল কাটাবে শিল...


শিল কাটাবে শিল... ,শিল কাটাবে শিল...।একটা সময় গ্রাম বাংলা এমন কি শহরের পাড়ায় পাড়ায় এই হাঁক শোনা যেত । হাতে ছোট একটা ব্যাগ নিয়ে ঘুরে ঘুরে বাড়িতে বাড়িতে শিল নোড়া কাটিয়ে জিবিকা অর্জন করতেন অনেকেই। দিনের শেষে যা আয় হত তা দিয়ে ভালভাবেই চলে যেত সংসার ।গৃহস্থের রান্না ঘরে মশলা বাটতে বাটতে মসৃণ হয়ে যাওয়া শিল নোড়া ফিরে পেত তার নতুন চেহারা। মশলা পেশায় করতেও কষ্ট কম হত। কিন্তু শিল নোড়া কাটানোর লোক আজ আর দেখা মেলে না। গ্রামবাংলাতেও মেলানো ভার। শক্ত পাথরের বুকে যারা খোদাই করে ফুটিয়ে তুলত শিল্প গৃহস্থের রান্না ঘরে তাদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে ।মানুষ বেশি করে যন্ত্র নির্ভর হয়ে পরেছে। মিক্সি মেশিনের যথেচ্ছ ব্যবহার এর ফলে গৃহস্থের রান্না ঘর থেকে শিল নোড়া প্রায় বিদায় নিয়েছে।বিদায়ের পথে শিল নোড়া কাটানো পেশাও। 

শক্ত পাথরের বুকে খোদাই করে সহজেই ছবি এঁকে দিতেন যারা , কাজটা কিন্তু অতটা সহজ ছিল না। তবুও পেশার তাগিদে অবলীলায় কাজটি করে যেতেন। কখনও মাছ, কখনও ফুল-ফল , কখনও পাখির ছবি ফুটে উঠত পাথরের শিলনোড়ায় ।ছোট একটা শেনি আর হাতুড়ি ছিল এদের কাজের হাতিয়ার । দীর্ঘদিন মশলা পেষার ঝাঁজ ও পাথরের গুঁড়োর হাত থেকে চোখ ও মুখকে রক্ষা করার জন্য কাপড়ের টুকরো ও চশমা ব্যবহার করতেন এরা । বর্তমান প্রজন্ম অনেকেই এই পেশা সম্পর্কে জানে না । আগামী প্রজন্ম হইতো জানবেই না এই পেশা সম্পর্কে ।



-- কুন্তল পাল   

 

Tuesday, September 8, 2020

কাঁথার দিন ফুরিয়েছে

         


জসিমউদ্দিনের ‘নকসিকাঁথার মাঠে’র কথা সকলেরই জানা। সাজু -রুপাইয়ের প্রেমকাহিনি প্রতিটি বাঙালিরই মনে গাঁথা আছে আজও। কাঁথায় যতœ করে ফুটিয়ে তোলা তাদের দুজনের প্রেম কাহিনি ভুলতে পারেনি কেউ। তবে কাঁথা বোনা প্রায় সকলেই ভুলে গিয়েছে। পুরানো কাপড় দিয়ে তৈরি রঙিন কাঁথার কথা আর কেউ বলে না। মা-ঠাকুমারা পুরানো কাপড় দিয়ে তৈরি করতেন সুন্দর সুন্দর কাঁথা।একটি কাঁথা পেতে মাপ আনতে কমপক্ষে দু-জনের  প্রয়োজন হয়। পাশের বাড়ির জ্যাঠিমা বা কাকিমার সাহায্যে পেতে নেওয়া দিনটিকে মনে রেখে শুরু হত কাঁথা বোনা। শেষ দিন এলে হিসাব করতেন কতদিন লাগলো কাঁথা বুনতে। পুরানো শাড়ির পাড় থেকে সুতো তুলে তা দিয়েই সেলাই করে ফুটিয়ে তোলা হত কাঁথা। কাঁথায় উঠে আসতো গ্রাম্যচিত্র। থাকত নানা জীবজন্তুর ছবি। ছেলের বিয়েতে নতুন কাঁথা দেবার রীতি ছিল মায়েদের কাছে।

কাঁথা সেলাই করার জন্য প্রয়োজনীয় ছিল সুঁচ, সুতো । এছাড়াও লাগত অংস্থান। মোটা কাপড় কেটে সেলাই করে অংস্থান বানিয়ে নিতে হত। অংস্থান আঙুলে পরেই কাঁথা সেলাই করতেন মা-ঠাকুমারা। রান সেলাই, হেম সেলাই, কাঁথাস্টিচ প্রভৃতি ছিল সেলাইয়ের মধ্যে অন্যতম। মেশিনে তৈরি বালাপোশ আর আধুনিক কম্বলের দাপটে আজ আর কাঁথার প্রয়োজন বোধ করে না কেউ। কাঁথা বোনার মানুষ গুলিও আজ আর  নেই। বর্তমান প্রজন্ম জানেই না কাঁথা বোনার পদ্ধতি। যে কারনেই আজ কাঁথা দেখা যায় না।


উল ও কাঁটার সাহায্যে সোয়েটার বা শীতের পোশাক বোনাও ছিল শিল্পের সমান। ক্রুশের সাহায্যে নানা ডিজাইনের পোশাক তৈরি হত একসময়। নামি দামি মেশিনের দাপটে সেসবের দিন ফুরিয়েছে। কেউ আর হাতে বোনা শীতের পোশাক পরতে চাই না। হারিয়েছে সে সব দিন। তবুও কোন কোন স্কুলে কর্মশিক্ষা ক্লাসের সৌজন্যে একটু বেঁচে আছে উল বোনা। তবে মায়েদের কালঘাম ছুটে যায় মেয়েদেরকে এসব শেখাতে। কারন মায়েরা তো অনেক আগেই এসবকে বিদায় জানিয়েছেন।

--- কুন্তল পাল

Sunday, September 6, 2020

আসন আর কেউ বোনে না

 


    টিন বা টালির চালের মাটির বাড়ি। গোবরে লেপা মসৃন বারান্দা। কোন অতিথি এলেই চালের আঁড়া থেকে একটি আসন এনে বসতে দেওয়া হত। মাটির কুঁজো থেকে একগ্লাস ঠাণ্ডা জল সঙ্গে তালপাতার পাখার ঠাণ্ডা বাতাস। এই ছিল মধ্যবিত্ত বাঙালির প্রথম আপ্যায়ন। বর্তমান সময়ে সেই আপ্যায়ন আর নেই। এসেছে দামি সোফা, ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানীয়। বাড়ির মা বোনেদের তৈরি সুন্দর সুন্দর আসন আজ আর দেখা যায় না। মাপ দিয়ে কাটা চটের বস্তার উপর উল ও সুতো দিয়ে বিভিন্ন চিত্র এঁকে ফুটিয়ে তোলার দিন শেষ হয়েছে। কখনও কখনও ছিট কাপড় কেটে ত্রিভ‚জের আকারে সেলাই করে বসিয়ে দেওয়া হত চটের উপর। পুরানো কাপড় দিয়ে পিছনের ও চারপাশের অংশ মুড়ে দিয়ে সুদৃশ্য করা হত। তালপাতা বা খেঁজুর পাতা দিয়েও বসবার আসন তৈরি হত। শীতের মরশুমে খেজুর গাছ ঝোড়ার সময় বাদ দেওয়া খেজুর পাতা সংগ্রহ করে কাখতেন বাড়ির মা বোনেরা। অবসর সময়ে সেই পাতা দিয়ে বুনতের আসন। এই সব আসন শিল্পের নিদর্শন হয়ে থাকত। 


বিকালবেলা শুকনো খেঁজুর পাতা নিয়ে পাড়ায় ঘুরে ঘুরে আসন বা চাটাই বোনার আনন্দই ছিল আলাদা। পাশের বাড়ির কাকিমা কিংবা বান্ধবীর সাথে চলত আসন বোনার প্রতিযোগিতা। চটের উপর কখনও কখনও নীতি কথাও ফুটে উঠত, যা বাড়ির দেওয়ালে যতœ সহকারে ঝুলিয়ে রাখা হত। সাদা কাপড়ের উপর বাচ্চাদের জন্য ছড়া বা ¯^রবর্ণ অথবা ব্যঞ্জনবর্ণ আজও গ্রামে গেলে কারও কারও বাড়িতে দেখা যায়। কার্পেট বা বাহারি সোফার ব্যবহারে সেসব আজ অতীত হয়েছে। আজ আর কেউ আসন ব্যবহার করে না। তবুও সুদৃশ্য চেয়ারে বসে আজও কারও কারও মনে পড়ে যায় আসনের কথা। দেওয়ালে ঝোলানো সুতোয় ফুটিয়ে তোলা নীতি কথাটি ধূসর মনে হয়--- ‘‘ ডালিম পাকিলে পড়ে নিজে ফেটে যায় / ছোটলোক বড় হলে বন্ধুকে কাঁদায়”


--- কুন্তল পাল



Friday, September 4, 2020

হারিয়ে গিয়েছে তালপাতার পাখা

     


এক'টা সময় ছিল মানব জীবন কিছু জিনিস ছাড়া চলত না ৷ যুগের পরিবর্তনের সাথে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক কিছুই । আধুনিক যন্ত্রচালিত মানব জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে বিদায় নিয়েছে তালপাতার পাখা । সেলুলয়েডের যুগে প্লাস্টিকের দাপটে তালপাতা আজ ব্রাত্য | কোলকাতার মত মহানগর নয় ! মফ্সলের শহর ঘুরেও আজ আর তালপাতার পাখা মেলানো যায় না । গাঁ গজ্ঞে হয় তো বা দুএকটা আজও স্বাক্ষ্য বহন করে চলেছে ৷

          ছোট ছোট নানা মাপের গোল গোল করে কাটা তালপাতার মাথা গুলি কঞ্চির চোছ দিয়ে মুড়ে দেওয়া হত ৷ যার ফলে সহজেই বাতাস কাটতে পারে । বাঁশের ফালি চিরে হাতাল লাগানো থাকে ৷ এখনও মুদির দোকানে ঝাটার সাথে বিক্রি হতে দেখা যায় । তবে তা যে কোন সময় হারিয়ে যাবার আশঙ্কায় দিন গুনছেন সাধারণ মানুষ । যদিও এ পাখার সাথে আসল তালপাতার পাখার পার্থক্য অনেক ৷ তালপাতার যে পাখা আমাদের চোখে ভাসে তার ধাঁচই আলাদা ৷ তালগাছের পাতার উপর নির্ভর করে পাখার আকার ৷ একটি পাতা দিয়ে সর্বোচ্চ দুটি পাখা তৈরি হয় ৷ পাতার ডাটি সমেত মাঝখান দিয়ে চিরে নেওয়া হয় ৷ সুবিধা মত ডাটি সাইজ করে তৈরি হয় হাতল । হাতল মসৃণ করে তেল মাখানো হয় ধরবার সুবিধার্থে ৷ পাতার শিরার মাপ করে গোল করে কাটা হয় , যাতে হাতলের সাথে যুক্ত থাকে সেদিকেও নজর রাখা হয় ৷পাতার ধার বরাবর বাঁশের সরু চোছ কাঠির মত আকারে সুতো দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয় , যাতে লখলখে না থাকে ৷ সহজেই যাতে নখের আঁচড়ে চিরে না যায় সেদিকেও নজর রাখা হয় | তবে , সবার আগে গাছ থেকে কাটার পর পাতাটিকে জলে ভিজিয়ে রাখা হয় ৷ না হলে শুকিয়ে ছোট হয়ে যাবার ভয় থাকে ৷ পাখাকে আরও সুন্দর করে তোলার জন্য তালপাতা চিরে সরু করে বরফি আকারে ধার বরাবর বেঁধে দেওয়া হয় ৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে আলতা দিয়ে সেই বরফি গুলি রং করে দেওয়া হত | মা -ঠাকুমারা রঙিন কাপড় বা কাপড়ের পাড় কুচি দিয়ে সেলাই করে পাখার ধার বরাবর বসিয়ে দিতেন ৷ হাতলে রঙিন সুতো জড়িয়ে দিতন যাতে প্রতিদিন ব্যবহারের ফলে তেল চিটে না হয়ে যায় ৷ অপরূপ এই পাখার শীতল বাতাসে জুড়িয়ে যেত প্রাণ ৷ শরীরের সব ক্লান্তি মুছে দিত পাখার হাওয়া ৷


          গ্রীষ্মের সময় বাড়িতে কেউ এলে বাড়ির ছোট দেরও দেখতাম তাঁর হাতে একটি পাখা এগিয়ে দিতে ৷ সাথে এক গ্লাস ঠান্ডা জল । ঠাকুমার পাশে শুয়ে অচিনপুরের গল্প শোনার অভিজ্ঞতা প্রায় সকলেরই আছে | গল্প বলতে বলতে ঠাকুমা হাতপাখা নেড়ে হাওয়া করতেন, কখন যেন ঘুমিয়ে পড়তাম ৷ ঘুমের ঘোরে পাখা নাড়ার শব্দ অপরূপ লাগত ৷ ঠাকুমাও ঘুমিয়ে পড়তেন ৷ ঘুমের ঘোরে গায়ে পাখার আঘাত লাগলে অদ্ভুত এক নিয়ম মেনে ক্ষমা চেয়ে নিতেন , পাখাটা মাটিতে ঠুকে নিতেন ৷ এ যেন মাটিতে মাথা ঠোকা ৷ শুধু শোবার ঘরে নয় , উনুনে বাতাস দেবার জন্য উনুনের পাশেও থাকত কালি ঝুলি মাখা একটা পাখা ৷ উনুনে হাওয়া দেওয়ার সময় পাখার শব্দ অদ্ভুত লাগত I জামাইষষ্ঠীর দিনে তালপাখা জলে ভিজিয়ে জামাইদের শুভ কামনায় শাশুড়ি বলতেন , ' ষাট্ ষাট্ , ষষ্ঠীর ষাট্ ' ৷ এ ছবি আজও দেখা যায় , তবে তা সিনেমায় ৷ 

          পাখা শুধু বাতাস দেওয়ার জন্যই নয় , মাছ চুরি করে পালানোর সময় বিড়াল কেই পাখার বাড়ি হজম করতে হত । মায়ের ঘুমের সুযোগে আচঁলের পয়সা 'চুরি' করে পাখার বাড়ি খেতে হয়েছে অনেক কেই ৷ তবে এসবের মধ্যে আনন্দও ছিল ৷ যা আজকের ছেলে-মেয়েদের কাছে গল্প কথা । এসব থেকে তারা বঞ্চিত হলেও আধুনিক এসি মেশিন তাদের সেই ব্যথা অনেকটাই মুছে দিয়েছে ৷ ইলেকট্রিক ফ্যান ও এসির বাতাসে মুছে গিয়েছে তালপাতার পাখার নাম ৷


      ....কুন্তল পাল