Friday, January 24, 2020

পরিবেশ বন্ধু শকুন

         
       দু দশক আগেও ছিল শকুনি গ্রাম বা শকুন পাড়া । একটা সময় ছিল যেখানে প্রতিটি গ্রামে কোথাও না কোথাও কোন গাছে বাস করত বিরাট আকারের শকুনের দল ৷ তাদের ত্যাগ করা বর্জে গাছের নীচে সাদা হয়ে থাকত ৷ অনেক সময় সাধারণকে ছাতা ব্যবহার করতে হত ৷ দুর্গন্ধে নাকে রুমাল দিতে বাধ্য হতেন সকলেই ৷ অনেকেই বিরক্ত হতেন | সন্ধ্যার পর আর শোনা যায় না শকুনের চিৎকার | এখন আর নেই শকুন পাড়া , নেই মানুষের বিরক্তি ৷ ৮০-র দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে কমতে শুরু করে বৃহৎ এই প্রাণী | বর্তমানে প্রায় ৮৭ শতাংশ কমে গিয়েছে চরে খাওয়া মাংসাশী প্রাণীটি ৷ মানুষের ঘৃণা ও অবেহলায় বিলুপ্তির পথে উপকারী ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষাকারী শকুন । তবে সাম্প্রতিককালে শকুনের উপকারিতা উপলব্ধি করেছে মানুষ । তাইতো আজ বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে শকুন দিবস (৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস ) । আন্টার্টিকা ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ বাদ দিলে বিশ্বের প্রায় সর্বত্র শকুন দেখা যায় ৷ সারা বিশ্বে ৩০ এরও বেশি প্রজাতির শকুন রয়েছে ৷ এদেরকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয় , নববিশ্বের শকুন ও পুরানো বিশ্বের শকুন ৷
          খাবারের জন্য পরিবেশের ময়লা আবর্জন সাফ করে নেয় শকুন । এমন কি চামড়া ও মাংস খেয়ে কঙ্কালে পরিণত করে অবশিষ্ট দেহাবশেষ ৷ যে কারণে এদের কে পরিবেশের বন্ধু বলা হয় । শকুনই একমাত্র প্রাণী , যারা পশু হত্যা করেনা । খাবারের জন্য পশুর মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করে | ১৮০০ সাল থেকে শকুনকে উপকারী হিসাবে গণ্য করা শুরু হয় ৷ মরা পশুর শরীর থেকে জীবানু ছড়ানো রোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এরা ৷ পরিবেশবিদদের মতে বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় অত্যন্ত উপকারী এই প্রাণী । পশুর শরীরে অ্যানথ্রাক্স , জলাতঙ্ক প্রভৃতি রোগ দিন দিন বেড়েই চলেছে ৷ যা ছড়িয়ে পড়ছে মানব শরীরেও | প্রখর হজম শক্তি হওয়ায় শকুন অ্যানথ্রাক্স , জলাতঙ্ক , বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ , গবাদি পশুর শরীরের বিভিন্ন জীবানু সহজেই হজম করতে পারে ৷ শকুনের ত্যাগ করা মলে শক্তিশালী অ্যাসিড উৎপন্ন হয় ৷ প্রখর হজম শক্তিতে উৎপন্ন হওয়া অ্যাসিড জীবাণু ও ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে সক্ষম ৷ যেটা ঢেঙ্গা নামক এক প্রকার পাখির মলে থাকে ৷
          শকুন প্রখর দৃষ্টিশক্তির অধিকারী | বহু উপর থেকে এরা খাবার লক্ষ করে । উন্মুক্ত সমতল থেকে ৪ মাইল দুরের ৩ ফুট আকারের বস্তুকেউ এরা পরিস্কার দেখতে পায় । শকুন খুবই আনুগত্য হয় , পরিবারের সাথে দীর্ঘ দিন আবদ্ধ থাকে ৷ বাচ্চা জন্মানোর পর প্রায় ৮ মাস তাদের দায়িত্ব পালন করে ৷ বিশ্রামের সময়ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখে | সাধারণত ১০ থেকে ১৫ বছর গড় হিসাবে বাঁচে এরা (কালো শকুন.) | একটি পূর্ণবয়স্ক শকুন প্রায় ৭৬ থেকে ১২২ সেমি লম্বা হয় | ডানা প্রায় ৩ মিটার , লেজ ১৬ - ২১ সেমি হয় ৷ মাথা ও গলায় কোন পালক থাকে না । এরা কাউকে আক্রমন করে না ঠিকই , তবে নিজেরা আক্রান্ত হলে পায়ের এক বিশেষ অঙ্গ দিয়ে আক্রমণ করে ( যে অঙ্গ খাবার সাফ করতে ব্যবহার হয় ) | নতুন পাতা দিয়ে বাসা বেধে ডিম পারে এরা.। বছরে এক বারই ডিম পারে ৷ কোন কারনে ডিম ভেঙে গেলে বাসাও ভেঙে ফেলে এরা ৷
          বিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে শকুন রোগ ছড়াচ্ছে বলে দাবি ওঠে ৷ হাতিয়ার হিসাবে একটি মহামারিকে সামনে রাখা হয় । সেই দাবি অনুসারে বিষ প্রয়োগ ও গুলি করে হাজার হাজার শকুন মেরে ফেলা হয় । গত কয়েক দশকে ভারতেও কমেছে শকুন | প্রায় ৯৮ শতাংশ শকুন কমেছে ভারতে ৷
          শকুন কমে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল ড্রাগ ৷ ডাইক্লোফেন , যা পশুর শরীরে অতিমাত্রায় প্রয়োগের ফলে বিষক্রিয়া ঘটছে শকুনের শরীরে ৷ ফলে কিডনির অসুখে ভুগে মারা যাচ্ছে এরা ৷ খাদ্যের ঘাটতিও অন্যতম কারন । বাসা বাধারও গাছের অভাব , ফলে প্রজননে বাধা পাচ্ছে | এককথায় পরিবেশই শকুনের কাছে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে I বিশেষজ্ঞদের ধারনা , বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী প্রাণী শকুন ক্রমশ হ্রাস পেলে নষ্ট হতে পারে সামগ্রিক প্রাণীজগতের বৈচিত্র I
          ...কুন্তল পাল
          

হারিয়ে যাচ্ছে কলমি , কুলেখাঁড়া , শুশনি

       
  ' বাগদী বুড়ি চুবড়ি ভরে নিয়ে / শাক তুলছে পুকুর পাড়ে বসে ' – বাগদী বুড়ির শাক তোলার দিন ফুরিয়েছে ৷ পুকুর পাড়ই হারিয়ে গিয়েছে | হারিয়ে গিয়েছে দেশি কলমি , কুলে খাঁড়া , শুশনি শাক । বদ্ধ জলাশয় , পুকুর , খাল বিল , নদী কোথাও আজ আর সেভাবে দেখা মেলে না এই সব শাক ৷ সব জায়গায় দখল নিয়েছে কচুরিপানা ৷ কচুরিপানার দাপটে নদীও হারাচ্ছে তার স্রোত | জেলেরাও তাদের পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন ৷ ইছামতি , কপোতাক্ষ , কোদালিয়া , গড়াইল , নাওভাঙা প্রভৃতি নদী আজ বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়েছে ৷ কচুরিপানায় আবদ্ধ হয়ে নদী হারিয়েছে তার স্রোত ৷ এইসব নদীতে আর জম্মায়না কলমি | অথচ এইসব নদীতেই একসময় খেলা করত কলমির কচি ডগা ৷
বিকাল বেলা গ্রামের মেয়ে -বৌয়েরা নদীর দুধারে শাক তুলত ৷ মাঠের জলের নালায় বেড়ে উঠত কত অজানা শাক ।এসব আজ অতীত ।
             কচুরিপানা অত্যন্ত লড়াকু মানসিকতার উদ্ভিদ ৷ দ্রুত বংশ বিস্তার করে এরা | এরা এতটাই আগ্রাসী যে এদের আশেপাশে কোন উদ্ভিদ জম্মাতে পারে না ৷ সেকারনেই যেসব জলাশয়ে কচুরিপানা রয়েছে সেখান থেকে হারিয়ে যাচ্ছে কলমি , কুলেখাঁড়া । চাষে অনিন্ত্রিত রাসায়নিক ব্যবহারে মাঠ থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে এই সব শাক ।

            কুন্তল পাল 

Thursday, January 23, 2020

বিপন্ন রাজ্যপশু বাঘরোল

       একদিন সকালে এলাকায় দেখা মেলে এক জন্তুর ৷ মৃত অবস্থাতেই পড়ে থাকতে দেখা যায় ৷ অনেকটা বাঘের মত দেখতে জন্তুটাকে নিয়ে নানা গুজব শুরু হয় ৷ পরে জানা যায় এটাই আমাদের রাজ্যপশু বাঘরোল ৷ এলাকায় কিছুদিন ধরে চুরি যাচ্ছিল হাঁস , মুরগি ৷ দিশেহারা হয়ে গ্রামের লোকজন ফাঁদও পাতেন | ফাঁদ ছিঁড়ে শিকার নিয়ে পালায় শিকারী ৷ প্রথমে সন্দেহ হয় শিয়ালের উপর ৷ কিন্তু ফাঁদের পাশে বাঘের মত পায়ের ছাপ সন্দেহ বদলে দেয় । তা হলে কি এলাকায় বাঘ ? আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এলাকাবাসী । এলাকার এক ব্যক্তির পোষা রাজহাঁস নিয়ে পালানোর চেষ্টা করে একটি জন্তু | তাড়া খেয়ে শিকার ফেলে পালিয়ে যায় । মৃত রাজহাঁসটিতে বিষ মিশিয়ে সেখানেই ফেলে রাখেন তিনি ৷ পর দিনই এলাকায় মৃত অবস্থায় ওই জন্তুটিকে পাওয়া যায় ৷ জন্তুটি ছিল বাঘরোল । কয়েক বছর আগে ঘটনাটি ঘটে উত্তর ২৪ পরগণার বাগদা থানার নৃসিংহখোলা এলাকায় ৷ এর দুদিন বাদেই এলাকার একটি ভেড়ির পাশ থেকে উদ্ধার হয়  বাঘরোল শাবক । চিতাবাঘের মত দেখতে শাবকটিকে বাড়িতে নিয়ে আসেন এক যুবক ৷ প্রাণীটি বাড়িতে রাখা বেআইনি জানাতে পেরে বনদপ্তরে খবর দেয় । জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন বন আধিকারিকরা ৷ আবারও লোকালয়ে চলে আসে শাবকটি ৷ অচেনা জন্তুটিকে কামড়ে মেরে ফেলে এলাকার কুকুর |
     
        এভাবে নানা কারনেই হারিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপশু বাঘরোল | সাধারণ বিড়ালের দ্বিগুণ আকার ও শক্তিশালী এই পশুটিকে অনেকেই মাছ ধরা বিড়াল বা মোছা বিড়াল নামে চেনেন | চলতি নাম হিসাবে বাঘডাশা , কুপায়া বাঘ প্রভৃতি নামেও পরিচিত ৷ প্রাণীবিদ্যায় Prionailurus Viverrinus নামে পরিচিত ৷ বাসস্থান Animalia . শুধুমাত্র ভারত নয় ৷ নেপাল , বাংলাদেশ , শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম , থাইল্যান্ড , বার্মা ,চিন , পাকিস্তান , ইন্দোনেশিয়া দ্বীপ এবং সুমাত্রা দ্বীপেও দেখা যায় বাঘরোল | ভারতীয় হিমালয় অঞ্চলে ১৫০০ থেকে ২১০০ মিটার উঁচুতেও দেখা মেলে রাজ্য পশু ৷ ৬৫ থেকে ৮৬ সেমি লম্বা ও ৫ থেকে ১৬ কেজি পর্যন্ত ওজন হয় ৷ লেজের আকার প্রায় ২৪ থেকে ৩৫সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয় ৷ উচ্চতা ৩০থেকে ৫৫ সেন্টিমিটার । শরীর ধূসর বর্ণের লোমে ঢাকা ৷ গায়ে লম্বালম্বি দাগ কাটা , মাঝে মাঝে কালো -বাদামি ছোপ ৷ চোখ ঈষৎ হলুদ , আলো পড়লে সবুজ আভা লক্ষ করা যায় ৷ এরা খুব ভালো সাঁতার কাটতে পারে ৷ দৌড়াতেও পটু , ঘন্টায় ৫৫ কিমি বেগে দৌড়াতে পারে ৷ এদের জীবনকাল খুবই সংক্ষিপ্ত ৷ মাত্র ১০-১৫ বছর বাঁচে এরা | মোটামুটি ৯ থেকে ১৮ মাস বয়সেই এরা সঙ্গমে লিপ্ত হয় । গর্ভধারণের প্রক্রিয়া ৬৩ থেকে ৭০ দিনে শেষ হয় | জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে এরা বাচ্চা প্রসব করে ৷ একটি মেয়ে বাঘরোল একসাথে ২-৩ টি বাচ্চা প্রসব করে | ১৬ দিন বয়সে চোখ ফোটে | দু মাস বয়স হলেই মাংস খাওয়া শুরু করে ৷ ৮-৯ মাসেই প্রাপ্তবয়স্ক ৷ ১২ থেকে ১৮ মাসে পুরোপুরি যুবক | রাত জেগে শিকার করার পর দিন এরা ঘন জঙ্গলে কাটায় । মুখে একপ্রকার আওয়াজ করে নিজেদের জানান দেয়৷
       
         এই জন্তুটিই আজ বিপন্ন ! The International Union for Conservation of Nature and Natural Resources ( IUCN ) , ২০১০ সালে এই প্রাণীটিকে বিপন্ন প্রাণী হিসাবে ঘোষণা করেছে । বন্যপ্রাণী আইন ১৯৭২ অনুসারেও বাঘরোল লুপ্তপ্রায় প্রাণী ৷ এদেরকে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন ৷ পরিবেশের সামঞ্জস্য বজায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে বাঘরোল ৷ সরকারি ভাবে কড়া পদক্ষেপ না নেওয়ায় দিন দিন কমছে বাঘরোলের সংখ্যা | বর্তমানে সারা দেশে মাত্র ৩ হাজার বাঘরোল রয়েছে ৷ বেশির ভাগই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে I যার সিংহভাগ হাওড়া জেলায় ৷ একসময় সুন্দরবনের জলাভূমি এলাকা , পূর্ব কলকাতার বিস্তৃর্ণ জলাভূমি ও হাওড়ায় প্রচুর পরিমানে বাঘরোল দেখা যেত । সাম্প্রতিক কালে সুন্দরবনের বেশির ভাগ এলাকা বাঘের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে , বাকি জায়গায় গজিয়ে উঠেছে বাসস্থান | কলকাতা হাওড়াতেও জলাভূমি বুজিয়ে বহুতল গড়ে উঠেছে,ফলে ওদের বাসস্থান ও আশ্রয়ের অভাব দেখা দিয়েছে ৷ এছাড়াও চোরাশিকারির দ্বারা আক্রান্ত হয়েও কমছে সংখ্যাটা ৷ মাছ এদের প্রিয় খাদ্য হলেও প্রচুর পরিমানে ইঁদুর খেয়ে এরা চাষে উপকার করে ৷ এছাড়াও নানা প্রকার সরীসৃপ, পাখি প্রভৃতি এদের খাদ্য |
       
       বাঘরোল কে বাঘের সমগোত্রীয় তুলনা করা হয় ৷ যদিও একটি বাঘকে বাঁচাতে সরকারী ভাবে যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় তার বিন্দু মাত্র উদ্যোগ নেওয়া হয় না বাঘরোলকে বাঁচাতে | আমাদেরকে উদ্যোগী হতে হবে৷ রাজ্য পশুকে বাঁচাতে পারলে এক দিকে যেমন চাষবাসে উপকার হবে , তেমনই রক্ষা হবে জীব বৈচিত্র । এরা বাঁচলেই রক্ষা হবে খাদ্য-খাদক শৃঙ্খল , বাঁচব আমরা ৷
                          ........শেষ
      কুন্তল পাল

Thursday, January 16, 2020

স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আস্তাবল শূন্য মঙ্গলগঞ্জ


           আস্তাবল শূন্য হয়েছে অনেক আগেই ৷ বর্তমানে আস্তাবলের কোন চিহ্নই আজ আর নেই ৷ অতীতের সেসব গল্প শুনে আজ কেউই বিশ্বাস করবে না , এখানেই ছিল বিরাট আস্তাবল | ছিল নহবত খানা , হেপাজতখানা, শিশু মহল , দরবার মহল , রাজমহল আরও কত প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন ৷ সে সবই আজ হারিয়ে গিয়েছে ৷ অতীত দিনের গৌরব হারিয়ে কঙ্কালসার ধ্বংসস্তুপের মত দাড়িঁয়ে আছে মঙ্গলগঞ্জের নীলকুঠী | কিছুদিন পর হয়ত শেষ স্মৃতি টুকুও ধুলোয় মিশে যাবে !

           উত্তর ২৪ পরগণার সীমান্তবর্তী বাগদা থানা | এই থানার অন্তর্গত মঙ্গলগঞ্জ একসময় ছিল দর্শনীয় স্থান ৷ ইছামতীর তীরে বিরাট এলাকা জুড়ে দাঁড়িয়ে নীলকুঠী । স্থানীয়রা অবশ্য 'সদন' নামেই জেনে এসেছে ৷ ইছামতীর একপাশে নীলকুঠী , অন্যপাশে বিভূতিভূষণ অভয়ারণ্য ৷ যেখানে রয়েছে রাজ্যের দ্বিতীয় ডিয়ার পার্ক |

           বিশাল এলাকা জুড়ে নীলচাষকে কেন্দ্র করে একসময় কর্মব্যস্ত ছিল নীলকুঠী । কালের নিয়মে ব্যস্ততা আজ আর নেই ৷ বিরাট কুঠীর সামান্য অংশ আজ বর্তমান | কয়েদ ঘরের তালা ভেঙে গিয়েছে অনেক আগেই । ঘরটিও আজ আর নেই ৷ নেই কাছাড়ি বাড়িটাও ৷ এখন শুধুই আগাছা ! অথচ এই কুঠীকে ঘিরেই ছিল কৃষ্ণচুড়া , রাধাচুড়া , বকুল, পলাশ , শিমূল আরও কত ফুল ফলের গাছ । এসব দেখতে দূর দুরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসত । আজ আর কেউ আসেনা ৷ বিষাক্ত সাপ আর বন্যজন্তুদের আস্তানা মঙ্গলগঞ্জে আজ বিষাদের সুর ৷

           অতীতদিনের দুএক জন ছাড়া মঙ্গলগঞ্জের ইতিহাস সম্পর্কে কারও তেমন ধারণা নেই | মঙ্গলগঞ্জের ইতিহাস জানতে বা জানাতে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি সরকার । দু-একটি বই থেকে কিছুটা জানা গেলেও নীলকুঠীর পুরো ইতিহাস অনেকেরই অজানা ৷ প্রায় ২০০ বছর আগে ভিত্তি পত্তন হয়েছিল নীলকুঠীর ৷ ৬৫ বিঘা জমিকে ঘিরে বিশাল নীলচাষ শুরু হয় । গোবরডাঙ্গার খাটুরা অঞ্চলের ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন মঙ্গলচন্দ্র আঁশ । অবিভক্ত বাংলায় ব্যবসায় খ্যাতি অর্জন করেছিলেন । বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহ থেকে সমগ্র যশোর জেলায় তাঁর ব্যবসা বিস্তার ছিল ৷ মঙ্গলচন্দ্রের পুত্র লক্ষণ চন্দ্র আঁশ | বারশালের বিধবাকে দ্বিতীয় বার বিয়ে করায় বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হ্য় লক্ষণ চন্দ্রের। সম্পর্ক ছিন্ন করার সময় ছেলেকে প্রচুর সম্পত্তি দেন মঙ্গলচন্দ্র | সেই সময় মঙ্গলগঞ্জের জমিদার ছিলেন কোন এক ঘোষ বাবু | ব্যবসায় সুবিধা করতে না পারায় নগদ অর্থের বিনিময়ে লক্ষণচন্দ্রকে জমিদারি হস্তান্তর করেন তিনি ৷ বাবার নাম অনুসারে এখানকার নাম রাখেন মঙ্গলগঞ্জ । ইছামতীর তীরে বিশাল জমি দেখে ভালো লেগে যায় লক্ষণ চন্দ্রের | সাহেব কোপানির সাথে যোগাযোগ করে পত্তন করলেন নীলকুঠী | সেখানকার রাজা হলেন লক্ষণচন্দ্র আঁশ । মাত্র ১০ বছর রাজত্ব করে মারা যান রাজা | একে একে মারা যান ৩ মেয়ে ও ২ ছেলে ৷ শেষ পর্যন্ত ছোট মেয়েই বেঁচে ছিলেন | এলাকায় পিসিমা নামে পরিচিত ছিলেন তিনি ৷

           এখানেই গড়ে উঠেছিল নীলের গুদামঘর , নীলপচানের চৌবাচ্চা ৷ যদিও এখন তার চিহ্নমাত্র নেই৷১৯০৩ সালে গুদামঘরে প্রাইমারি স্কুলের প্রতিষ্ঠা হয় ৷ পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালে একটি ঘরে পোস্ট অফিসের অনুমোদন দেন পিসীমা সাবিত্রী আঁশ | তাঁর সাথে পরিচয় ছিল তৎকালীন কালিম্পং এর এম পি মৈত্রী বোসের ৷ তাঁর সাথে আলোচনা করে বিরাট এই এলাকা ভারত সরকার পরিচালিত 'শিশুরক্ষা সমিতি'কে দান করেন সাবিত্রী আঁশ । মোটামুটি ষাটের দশকে সম্পত্তি দান করে এলাকা ছেড়ে চলে যান তিনি ৷ এরপর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনাথ ছেলে-মেয়েরা এখানে আসতে শুরু করে । তবে এখন আর নেই তারা।  ওই সমিতির বিরুদ্ধেও অভিযোগ ওঠে ৷ বিদেশ থেকে অনুদান সত্ত্বেও অভুক্ত থাকতে হত শিশুদের.৷

           জলপথে যোগাযোগের সুবিধা থাকায় অল্পদিনেই বিস্তার লাভ করে মঙ্গলগঞ্জের নীল চাষ । জলপথে উৎপাদিত নীল পাড়ি দিত বিভিন্ন দেশে । এলাকার সমস্থ চাষীকেই বাধ্য করা হত নীল চাষে । অবাধ্য চাষীদের উপর চলত নির্মম অত্যাচার | দেশ স্বাধীন হলে চলে যায় ইংরেজরা ৷ সদাব্যস্ত ও চোখ রাঙানির হাত থেকে রক্ষা পেয়ে শান্ত হয় নীলকুঠী । প্রাইমারি স্কুল ও কচিকাচাদের কোলাহলে নবজীবন ফিরে পায় মঙ্গলগঞ্জ ৷ ফুলে ফলে ভরা মঙ্গলগঞ্জে তখন শুধুই পাখির কলোরব | কালে কালে তা শেষ হতে থাকে ৷ এখন আর একটিও গাছ নেই স্বাক্ষ্য বহন করার জন্য I দু-এক টি যা আছে তা বর্তমান প্রজন্মের ৷ বিরাট শালবাগান চুরি হয়ে গিয়েছে ৷ দখলদারিতে কমে এসেছে বিরাট এলাকা। চুরি হয়েছে জমিদারির শ্বেত পাথরের টেবিল , রূপোর ফুলদানি , ঝাড়লণ্ঠন আরও কত কিছু |

           মঙ্গলগঞ্জের বিরাট এই এলাকাকে কেন্দ্র করে এখানেই গড়ে উঠতে পারত পর্যটন কেন্দ্র ৷ পড়ে থাকা বিরাট খেলার মাঠকে কেন্দ্র করে তৈরি হতে পারত স্পোটর্স কমপ্লেক্স ৷ সরকার উদ্যোগী হলে এখনও এখানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব ৷ পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠলেই মানুষজন আসবেন নীলকর সাহেবদের স্বাক্ষ্য বহনকারী মঙ্গলগঞ্জে ৷ আবারও কোলাহলে মেতে উঠবে নীলকুঠী , থাকবে না শুধুই ইংরেজদের চোখরাঙানি ৷
                ....শেষ।

.... কুন্তল পাল

Wednesday, January 15, 2020

মাঠের গাছ জ্বলছে ভাঁটায় , অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার লড়াইয়ে শিউলিরা








  " সবার চেয়ে খেতে ভালো পাউরুটি আর ঝোলা গুড় " ....

লাইনটা মনে পড়লেই মনে পড়ে শীত কালের কথা ৷ শীত মানেই খেজুর রস নলেন গুড় , পিঠে -পায়েস-পুলি | শীত মানেই জয়নগরের মোয়া | শীতের সকালে কাঁপতে কাঁপতে এক গ্লাস মিষ্টি খেজুর রসের তুলনা হয় না ৷ কাঠাল পাতায় গরম খেজুর গুড় মনে করিয়ে দেয় হারানো শীতের শৈশব ।



        যারা খেজুর রস ও নলেন গুড় তৈরি করে তাদের শিউলি বলে | হিন্দু সম্প্রদায় ভুক্ত প্রাচীন এক জাতি | প্রাচীনকাল থেকেই খেজুর গাছ থেকে রস বার করার কাজ করে আসছে ওরা | সেই রস থেকে গুড় ও তৈরি করে ৷ তবে তাদের আজ আর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে | এসেছে অন্যান্য জাতির মানুষ | বাধা পেয়েছে তাদের সাধের পেশা | এখন আর এই পেশায় কেউ আসে না ৷ যাকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকবে এই পেশা সেই খেজুর গাছই আজ আর দেখা যায় না ৷ সারি সারি মাঠের খেজুর গাছ পুড়ছে ভাটায় | অবশিষ্ট দুএকটি গাছ আঁকড়ে পেশাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার শিউলিরা ৷ আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হয় গাছ পরিস্কার করার কাজ I প্রথমে গাছ ঝোড়া | এরপর গাছে চাছ দেওয়া হয় | অগ্রহায়ন মাসে গাছে বসে কন্ঠনালি | সেই নালি দিয়েই বের হয় মিষ্টি রস | এক একটি করে গাছের শুকনো পাতা কেটে ফেলতে হবে সবার আগে ৷ বালিকাচায় ধার তুলে তুলে জুৎসই করে নিতে হবে ছ্যান ৷ সেই ধারালো ছ্যান দিয়ে গাছের আগা চেঁছে চেঁছে কন্ঠনালি বসাতে হবে ৷নলের মুখে বসাতে হবে


ভাঁড় , সেই ভাঁড়ে সারা রাত টুপ টুপ করে জমবে রস ৷ খেজুর গাছেরও লিঙ্গভেদ রয়েছে৷ মেয়ে গাছে রস বেশি হয় | পুরুষ গাছের তুলনায় মিষ্টিও হয় বেশি | কত বছর ধরে একটি গাছ রস দিচ্ছে তা গাছের গায়ে গাট গুনে বলে দেওয়া যায় ৷ কিছু কিছু গাছ কে রেস্ট বা জিরোতে দেওয়া হ্য় | মাঝে মাঝে কাটা হ্য় | সেকারণে সেইসব গাছের রসকে জিরেন রস বলে৷ সাধারণ রসের তুলনায় জিরেন রস মিষ্টি বেশি হয় ৷ রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করাও কষ্টসাধ্য কাজ | গুড় তৈরি হতে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে | গুড় সম্পূর্ণ হওয়ার ২০ মিনিট আগে তৈরি হয় নলেন গুড় ৷ এরপর ঝোলাগুড় , দানাগুড় , জিরেন গুড় , চিটেগুড় প্রভৃতি | গুড় তৈরি হয়েছে কিনা ,তা কড়াইয়ে 'বিচ মেরে ' বোঝা যায় ৷ নারকেল মালা ও বাঁশ দিয়ে তৈরি হয় গুড় তোলার পাত্র I নলেন গুড় ও পাটালির চাহিদা সবচেয়ে বেশি | রস জ্বালিয়ে কলাপাতার উপর জমানো হয় পাটালি ৷ এককাট , দোকাট , তেকাট রস হয় গাছ থেকে ৷ অনেকে আবার চৌকাট রস বের করে ৷এককাট রস দিয়ে তৈরি হয় নলেন গুড় ৷ দোকাট বা তে কাট রস দিয়ে তৈরি হয় ঝোলাগুড় ৷ এই গুড়ের স্বাদ কিছুটা টক হয় ৷ রস গুড়ে পরিনত হলেই স্বার্থক হবে "খেজমৎ মেহনৎ " |

        খেজুর রস থেকে তৈরি নলেন গুড় বাংলার মানিচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে প্রাচীনকালেই । নলেন গুড়ের সন্দেশ বা রসোগোল্লা গ্রাম থেকে শহর এমন কি বিদেশেও সুখ্যাতি লাভ করেছে ৷ নলেন গুড়ের পায়েসের তুলনায় হয় না | বাঙালির অতি প্রিয় জয়নগরের মোয়ার প্রধান উপকরণই নলেন গুড় । খেজুর রস কিছুটা জ্বালানোর পর লালচে হলে তাকে তাঁতরস বলে ৷ তাঁতরস দিয়ে মুড়ি খাওয়ার জন্য বাঙালি আজও অপেক্ষা করে থাকে ৷দল বেঁধে রস চুরি আজও গ্রামবাংলার কিশোর যুবকদের কাছে আনন্দের ৷ ভয়ে ভয়ে গাছে উঠে পাটকাঠির নলে ভাঁড়ের রস খাওয়ার মধ্যেই যেন আনন্দ খুঁজে পায় ওরা | তবে এটাকে চুরি বলতে নারাজ অনেকই । গাছের মালিকও এসবের মধ্যে নিজের শৈশবকে খোঁজার চেষ্টা করে৷ নরেন্দ্রনাথ মিত্রের লেখা 'রস' গল্পে বর্ণিত হয়েছে খেজুর রসের কাহিনী | জোয়ান মোতালেফ ও রাজেক মৃধার বিধবা স্ত্রী মাজু খাতুনের প্রেম কাহিনী | সিনেমাও তৈরি হয়েছে ৷ 'সওদাগর' সিনেমায় অমিতাভ বচ্চনের অভিনয় আজও দর্শকের মনকে টানে ৷
       
এত কিছুর মধ্যেও গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের পেশাকে বাঁচিয়ে রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে শিউলিরা | এক দিকে নতুন করে এই পেশায় না আসা , অন্যদিকে খেজুর গাছের অভাব । দুয়ে মিলে হারিয়ে যেতে বসেছে এই পেশা | গ্রাম বাংলার শিউলি দের গলায় হতাশার সুর " নতুন করে কোন পুলাপান আর আসছে না । নিজের পুলাও আর একাজ করতে চাইছে না । এখন আর কেউ খেজুর গাছেই উঠতে পারে না , পেশা বাচবে কেমনে ? " অনেকেই মাঠের খেজুর গাছ কেটে ভাটায় জ্বালানি হিসাবে বিক্রি করে দিচ্ছে মোটা টাকার লোভে । ফলে কমছে গাছ ৷

        এক সময় বাংলাদেশ থেকেও শীতের মরশুমে অনেক শিউলি আসত এই বাংলায় | আজ আর আসে না ! কমেছে গাছ , কমেছে শিউলি ৷ নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, উত্তর ২৪ পরগণা , দক্ষিণ ২৪ পরগণা , হাওড়া প্রভৃতি জেলায় আজও শিউলিদের দেখা যায় ঠিকই , তবে তাদের চোখে মুখে করুন আর্তি ... ' যেন না হারায় এই পেশা '| গাছির আদর গাছই বোঝে ৷ গাছের মালিকরা বুঝলে অস্তিত্ব বাঁচানোর লড়াইয়ে লড়তে হত না গ্রাম বাংলার শিউলিদের |  ..... শেষ 

.... কুন্তল পাল