"কুমোড় পাড়ার গরুর গাড়ি / বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি " - কবিতায় কুমোড়পাড়া থাকলেও বাস্তবে আজ আর কুমোড়পাড়া দেখা যায় না বললেই চলে ৷ যদিও বা কোথাও কোথাও দেখা যায় তার সাথে অতীত দিনের কুমোড়পাড়ার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না | কালের পরবর্তনের সাথে সাথে কুমোড় পাড়া আজ শুধুমাত্র ঠিকানায় এসে দাড়িয়েছে ৷ যে পাড়ায় একসময় মাটির পাত্র পোড়ানোর গন্ধে বাতাস ভরে যেত , সেখানকার বাতাসে আজ আর পোড়া মাটির গন্ধ পাওয়া যায় না । মাটির পাত্র পোড়াবার ঘরগুলি আজ স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । কোথাও কোথাও সেই চিহ্নটুকুও নেই ৷ অজপাড়া গাঁ ঘুরে যদিও বা দু-একটি কুমোড় কে দেখা মেলে , তারা আজ যন্ত্র নির্ভর । তাদের তৈরি মাটির পাত্রে নেই কোন শিল্পের ছোঁয়া ৷ তাদের লক্ষ্য একটাই পেশাটাকে বাঁচিয়ে রাখা ।
কুমোড়দের কাজের প্রধান জিনিস চাক বা চাকা । চাক ঘুরিয়েই তার সাহায্যে তৈরি হত মাটির জিনিস । পোন ঘরে বসে ডুকনি বা কেঠে , বউল্লা ও পিট নির সাহায্যে মাটির পাত্রের পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া হত । শেষে পোনে পুড়িয়ে বাজারে নিয়ে যাওয়া হত বিক্রির জন্য | চাক দেখতে অনেকটা গরুর গাড়ির চাকার মত। চাকার নীচে থাকে 'আল' , যা তেঁতুল কাঠ দিয়ে তৈরি হয় ৷আলটি বসানো থাকে পাথরের উপর যাকে বলা হ্য় 'শিল '| চাকার মাঝখানে ছ্যানা মাটির চাঁই বসিয়ে দেওয়া হয় ৷ অনেকটা পিরামিডের মতন করে ৷ চাকার যে কোন একপ্রান্তে ছোট একটি গর্তে লাঠি বাঁধিয়ে চাক ঘোরানো হয় ৷ ঘুরন্ত চাকের মাটিতে হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হয় সুদৃশ্য মাটির পাত্র | পাত্র তৈরি হয়ে গেলে সরু বাঁশের চোঁছ দিয়ে কেটে আলাদা করা হয় এবং দু হাতের ফাঁকে অতি সতর্কতার সাথে ধরে আলাদা করা হয় শুকানোর জন্য ৷ অর্ধ শুকনো মাটির পাত্রের সাথে গোলাকার মাটির চাকতি জুড়ে দেওয়া হয় । ডুকনির মধ্যে রেখে 'বউল্লা ' দিয়ে পিটিয়ে বড় করা হয় মাটির চাকতি ৷ এরপর পিটনি দিয়ে আস্তে আস্তে বাড়ি মেরে জোড়া লাগানো হয় ৷ শক্ত ও মোটা দেশলাই বাক্সের মতন কাঠের মাঝখানে গোল করে কেটে অনেকটা মালসার মত আকার দেওয়া হয় , যাকে ডুকনি বলে । ডুক নির মধ্যে গোলাকার মাটির চাকতিকে বউল্লা দিয়ে পিটিয়ে বড় করা হয় । বউল্লা দেখতে উল্টানো ঘটের মত । পোড়া মাটি বা পাথরের তৈরি । পাত্রের দুটি অংশ জোড়া লাগানোর পর পিটনি দিয়ে পিটিয়ে পাত্র তৈরি হয় ৷ পিটনি দেখতে ছোট ক্রিকেট ব্যাটের মত ৷ কাঠের তৈরি ৷ পূর্ণাঙ্গ পাত্র রোদে শুকিয়ে তারপর পোনে পোড়ানো হয় ৷
পুড়িয়ে পাকা করাও কম ঝামেলার নয় ৷ যেখানে মাটির পাত্র পোড়ানো হয় তাকে 'পোন ' বলে ৷ বেশ কিছুটা উঁচু করে জায়গা জুড়ে মাটির দেওয়াল দেওয়া থাকে ৷ মাঝখানেও ছোট করে একই ভাবে মাটির দেওয়াল দেওয়া থাকে ৷ তাতে মাটি দিয়ে ছাদও দেওয়া হয় | ছোট গোলাকার এই অংশ টিকে 'তালকা' বলে ৷ তালকার চারিপাশে নীচের দিকে ছোট ছোট ছিদ্র থাকে , যেখান দিয়ে আগুন বের হয় ৷ তালকার নীচ দিয়ে সুরঙ্গ করে বাইরে মুখ বার করা হয় , যেখান দিয়ে আগুন ধরানো হয় ৷ আগুন দেবার এই মুখকে বলে 'মোয়ার' । শুকনো ঝরা পাতা দিয়ে আগুন করা হয় । এর ফলে আগুন ভালো হয় ৷ পোনের দেওয়ালের চারি দিকে নীচে ছোট ছোট ছিদ্র থাকে বাতাস আসা-যাওয়ার জন্য ৷ এই ছিদ্র গুলি কে 'ঝিল` বা 'গালা' বলে | মাটির পাত্র পোড়ানোর আগে পালা দেওয়া হয় | মাটির পাত্র সাজিয়ে কাঁচা ডালপালা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় একে 'পালা' বলে ৷ পালা দেবার পর তার উপরে পোড়া মাটির ভাঙা টুকরো বা খাবরা দেওয়া হয় ৷ এরপর কাদামাটির প্রলেপ ৷ সবশেষে মোয়ারের মুখে আগুন ধরানো হয় ৷ ঝিল বা গালার মুখ দিয়ে দেখে বোঝা যায় পোড়ানো হয়েছে কিনা ৷ পোড়ানো শেষ হয়ে গেলে বেশ কয়েক ঘন্টা পর ঠান্ডা হলে সাবধানে বের করা হয় পোড়া মাটির পাত্র ৷ এভাবেই তৈরি হয় কলসি , হাঁড়ি , রসের ভাঁড় প্রভৃতি ৷ এই পোড়া মাটির পাত্র গরুর গাড়ি করে বংশিবদন ও ভাগ্নে মদন হাটে নিয়ে যেতেন , যা আজ আর দেখা যায় না ৷
___ কুন্তল পাল